রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের তিস্তা সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেতুটি গাইবান্ধাকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করছে। এটি তিস্তার দক্ষিণ অংশে সুন্দরগঞ্জের হরিপুর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে।
সেতুর নিচে এখন তিস্তার সরু প্রবাহ। দুপাশে বিস্তীর্ণ বালুচর। সেখানে পেঁয়াজ, ভুট্টার আবাদ করেছেন স্থানীয় চাষিরা। এছাড়া, এলাকাটি রূপ নিয়েছে পর্যটন অঞ্চলে। সেখানে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন হাজারও দর্শনার্থী।
হরিপুরের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। এরপর থেকে কাজ দেখতে আশপাশের লোকজন এখানে আসতে শুরু করেন। সেতুর বেশির ভাগ অংশ দৃশ্যমাণ হওয়ার পর থেকে আশপাশের জেলা, উপজেলার মানুষও আসতে থাকেন। দর্শনার্থীদের চাহিদা মেটাতে এখানে স্থায়ী, অস্থায়ী দোকানপাটও গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে তাঁদের এ এলাকাটি আঞ্চলিক পর্যটনকেন্দ্রের রূপ নিয়েছে।
সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। সময়সূচি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কুড়িগ্রাম, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও চিলমারী থেকে সড়কপথে ঢাকার দূরত্ব কমে আসবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। চিলমারীর সঙ্গে কমবে বিভাগীয় শহর রংপুরের দূরত্বও।
চিলমারী থেকে সুন্দরগঞ্জ হয়ে গাইবান্ধার দূরুত্ব মাত্র ২৫-৩০ কিলোমিটার। অথচ চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম সদরের মানুষকে একমাত্র তিস্তা নদীর কারণে লালমনিরহাট জেলায় নির্মিত তিস্তা সেতুর ওপর দিয়ে রংপুর হয়ে গাইবান্ধায় ঢুকতে হতো। এখন এই সেতু চালু হলে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে পৌঁছা যাবে। তাতে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রায় দুই ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া চিলমারী, সুন্দরগঞ্জ এলাকার মানুষের রুটি-রুজির পথ প্রশস্ত হবে। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য স্বল্প সময়ে বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করতে পারবেন। ফলে জীবন-জীবিকারও উন্নতি ঘটবে।
সুন্দরগঞ্জের বেলকা এলাকার বাসিন্দা এরশাদ হোসেন বলেন, সুন্দরগঞ্জ ও চিলমারীর দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। মাঝখানে বয়ে গেছে তিস্তা। শীতকালে এটি শীর্ণকায় হলেও বর্ষায় ভরা যৌবনা। তখন তিস্তাপাড়ের দুই উপজেলার কয়েক লাখ মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয় খেয়া পারাপার। সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে যায় সেটাও। তখন কোনো কারণে খেয়া ধরতে না পারলে রাত কাটাতে হয় নদীর পাড়ে। সেতুটি হলে এই দুর্ভোগও ঘুচবে।
সম্প্রতি হরিপুরে গিয়ে দেখা যায়, চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতুর ৩০টি পিলারের মধ্যে সবগুলোই বসেছে। স্প্যানসহ পুরো অবকাঠামোই দৃশ্যমান। তবে সেতুর ওপর ফিতা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করা। তবু মাঝেমধ্যে দুয়েকটি মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলতে দেখা গেল। নিচ দিয়েও গেল একটি বাইক।
কয়েকজন দর্শনার্থী বললেন, তাঁদের অনুমান, গাড়িগুলো সেতুর নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির। সাধারণের জন্য সেতু এখনো উন্মুক্ত নয়।
সরজমিনে আরও দেখা যায়, সেতুর নিচে সরু তিস্তা। দুপাশে বিস্তৃত বালুচর। সেখানে রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টার আবাদ। তাতে কাজ করছেন নারী-পুরুষেরা। হাজারও দর্শনার্থী এসেছেন ঘুরতে।
খেতে কাজ করা দুজন নারী বললেন, চরে রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টার আবাদ ভালো হয়। সেতুটি চালু হলে এদিকে যান চলাচল সহজ হবে। তখন এখানকার পণ্য সহজে রংপুর, এমনকী ঢাকায়ও পাঠানো যাবে। দামও ভালো পাওয়া যাবে। সেতু দেখতে এসে চরের আবাদও ঘুরে দেখছেন অনেকে। ফলন দেখে সবাই প্রশংসা করছেন।
ঘুরতে এসে ভুট্টা খেতের পাশে গানের আসর জমিয়েছেন একদল তরুণ। তাঁরা বলেন, এখানে প্রকৃতি অনেক সুন্দর। একপাশে নদী। আরেক পাশে চরের আবাদ। ফলনও বাম্পার। এমন পরিবেশের কথা শুনে গানের আসর জমানোর সব সরঞ্জাম নিয়েই তাঁরা এসেছেন।
সরজমিনে আরও দেখা যায়, দর্শনার্থীদের কেউ চরের ফসলি আবাদের ছবি তুলছেন। কেউবা সেতুর সঙ্গে স্মৃতি ধারণ করছেন। কেউ সেতুর পাশে দোকানে চা ফুঁকছেন।
চায়ের দোকানে কথা হয় কবির হোসাইনের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায়। তিনি জানালেন, তাঁর কর্মস্থল গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায়। সেখানকার এক বন্ধু তাঁকে এখানে ঘুরতে নিয়ে এসেছেন।
শুধু কবির নন, তাঁর মতো আরও অনেকে ভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে এখানে ঘুরতে আসেন বলে জানালেন চা দোকানি জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতুর কারণে এ এলাকায় প্রতিদিনই অনেক দর্শনার্থী আসেন। তবে শুক্র-শনিসহ বন্ধের দিন ভিড় বেশি। এসব দিনে কয়েক হাজার মানুষ ভিড় জমান এখানে। এতে তাঁদের বিক্রিবাট্টা ভালো হয়। মানুষও ঘুরে আনন্দ পায়।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাইবান্ধা শহরের শাহ আবদুল হামিদ স্টেডিয়ামে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে এ সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ভূমি অধিগ্রহণ, মূল সেতু ও সংযোগসড়ক নির্মাণ, সম্প্রসারণ এবং নদী শাসনসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৮৫ কোটি টাকা।
সেতুর উভয় পাশে ৮৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৬ কিলোমিটার গাইবান্ধা অংশে। বাকিটা কুড়িগ্রাম অংশে। এছাড়া দুই তীরে স্থায়ীভাবে নদী শাসন করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার। যা নদীভাঙন রোধে বিশেষ অবদান রাখবে।
শুধু তাই নয়, সড়কগুলোতে নতুন করে ৫৮টি বক্স কালভার্ট এবং ৯টি আরসিসি সেতুও নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯৬ মিটার দীর্ঘ একটি, ৪৮ মিটার দীর্ঘ দুটি, ২০ মিটার দীর্ঘ দুটি, ১৬ মিটার দীর্ঘ একটি এবং ১২ মিটার দীর্ঘ তিনটি সেতুর নির্মাণের কাজ চলছে।
গাইবান্ধা জেলা (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সাবিউল ইসলাম জানান, চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতু প্রকল্পের কাজ চলছে পুরোদমে। মে মাসের মধ্যে মুল সেতুর কাজ শেষ হবে। তবে সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হতে জুন মাস পর্যন্ত সময় লাগবে।
ওকালতি পড়ে কৃষি উদ্যোক্তা : মাসুদের ‘হালাল আয়’ কোটি টাকারও বেশি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।