জুমবাংলা ডেস্ক: দক্ষিণ আমেরিকা ও মেক্সিকোর ওষুধিগুণ সম্পন্ন এবং মানবদেহের জন্য পুষ্টিকর শস্যদানা ‘চিয়া বীজ’। গোপালগঞ্জ হর্টি কালচার সেন্টারে পরীক্ষামূলক চাষ করে এর ভালো ফলন পাওয়া গেছে। নিউজবাংলা-র প্রতিবেদক মোজাম্মেল হোসেন মুন্না-এর প্রতিবেদনে বিস্তারিত উঠে এসেছে।
জেলার কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল ইউনিয়নে অবস্থিত হর্টি কালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ আমিনুল ইসলাম ৩০ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চিয়া চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গোপালগঞ্জের মাটিতে চিয়া বীজের বাম্পার ফলন কৃষকদের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। চিয়া চাষ এলাকায় ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে। অনেক কৃষক এই চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’
কৃষিবিদ বলেন, ‘মেক্সিকোসহ ইউরোপের দেশগুলোতে চিয়া একটি ওষুধি ফসল হিসেবে চাষ হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম সালভিয়া হিসপানিকা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মেহেদী মাসুদ কানাডা থেকে চিয়া বীজ দেশে আনেন। এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার মাটিতে চিয়া বীজের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেন তিনি।
‘তার দেখাদেখি গোপালগঞ্জের মাটিতে আমিও চিয়া চাষ করি। প্রথমে হর্টি কালচার সেন্টারের মধ্যে তিনটি প্লটে ভাগ করে মোট ৩০ শতাংশ জমিতে চাষ করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আবহওয়া ও মাটি চিয়া চাষের জন্য উপযোগী। এটি বেলে দোয়াশ মাটিতে ভালো জন্মে। সুপার ফুড হিসেবে খ্যাত চিয়া বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক এবং ক্যাফিক অ্যাসিড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, দ্রবনীয় এবং অদ্রবণীয় আঁশ।’
আমিনুল ইসলাম জানান, এক আউন্স চিয়া বীজে রয়েছে প্রায় ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১১ গ্রাম ফাইবার, ১৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট। এতে দুধের চেয়ে পাঁচগুন বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে দ্বিগুন, পালং শাকের চেয়ে তিনগুন ও ব্রকলির চেয়ে সাতগুণ পুষ্টিগুন রয়েছে।’
দৈনিক এক আউন্স চিয়া বীজ খেলে শতকরা ১৮ ভাগ ক্যালশিয়ামের চাহিদা, ২৭ ভাগ ফসফরাসের চাহিদা এবং ৩০ ভাগ ম্যাঙ্গানিজের চাহিদা পূরণ হতে পারে। যা মানবদেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টরল (এলডিল) হ্রাস করে এবং উপকারি এইচডিএল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ছাড়া ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চিয়া বীজ।
তিনি আরও জানান, চিয়া সাধারণত তিন মাসের ফসল। অক্টোবর মাসে বীজ বপন করতে হয়। ৫২ শতকের ১ বিঘা জমিতে মাত্র ৭০০ গ্রাম বীজ লাগে। চাষ পদ্ধতিও খুব সহজ। তিন মাসে তিনবার সেচ ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। অনেকটা তিল তিষি চাষের মতোই। যেকোনো চাষী বা কৃষক এটি চাষ করতে পারবেন। প্রতি বিঘা জমিতে সব মিলে খরচ হবে মাত্র সাত হাজার টাকা।
হর্টি কালচার সেন্টারের উপপরিচালক বলেন, ‘চিয়া লাভজনক চাষও বটে। প্রতি শতাংশ জমিতে ৩ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত চিয়া উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রকার ভেদে ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। উৎপাদন ও বাজার মূল্য অনুযায়ী, ১ বিঘা জামিতে খরচ বাদে লাভ হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে একজন কৃষকের অন্য কোনো কৃষিপণ্যে এত লাভ হওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া হিসপানিকা উদ্ভিদের বীজই চিয়া সিড বা বীজ। আদি জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকা। সেখানকার প্রাচীন আদিবাসী অ্যাজটেকরা তাদের খাদ্য তালিকায় চিয়া বীজকে সোনার চেয়েও মূল্যবান মনে করত। তারা বিশ্বাস করতেন এটা তাদের শক্তি ও সাহস জোগাবে।
‘সব ধরনের আবহাওয়ায় জন্মানো চিয়া বীজ দেখতে সাদা ও কালো রঙের তিলের মতো ছোট সাইজের হয়। অনেকেই এই বীজকে তোকমাদানা ভেবে ভুল করেন।’
রাতইল গ্রামের কৃষক মাসুদ মোল্লা বলেন, ‘হর্টি কালচার সেন্টারে চিয়ার চাষ হয়েছে। এটি চাষ করা খুবই সহজ। সরিষা বা তিলের মতোই চাষ করা যায়। তিন মাসের ফসল। এর বাজার দরও ভালো। আগামী মৌসুমে আমি এই ফসল চাষ করব বলে বীজের অর্ডার দিয়েছি।’
একই গ্রামের কৃষক কামরুজ্জামান শেখ সবুজ, বাবুল মোল্লা, খায়ের মোল্লার সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। আগামী মৌসুমে তারাও চিয়া চাষ করবেন বলে জানান। তবে তুলনামূলক দামি বলে উৎপাদিত ফসলের বিক্রি নিয়ে তাদের একটু চিন্তা আছে।
তারা বলেন, ‘কৃষি বিভাগ যদি আমাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমরা চিয়া চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করব।’
হর্টি কালচার সেন্টারের উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চিয়ার বীজ উৎপাদনের জন্য আমরা সেন্টারের মধ্যে পরীক্ষামূলক চাষ করেছি। এ বছর যে বীজ হবে সেগুলো গোপালগঞ্জের আগ্রহী কৃষকদের মধ্যে বিতরণ ও এক দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আমাদের ইচ্ছা গোপালগঞ্জের কৃষক দামী এই শস্য চাষ করে নিজেদের ভ্যগ্য পরিবর্তন করুক।’
গোপালগঞ্জ আড়াইশ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘চিয়া বীজ দেহের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে, ওজন কমায়, রক্তে সুগার স্বাভাবিক রাখে, হাড়ের ক্ষয়রোধ করে।
‘এ ছাড়া মলাশয় পরিষ্কার রাখে, ফলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। চিয়া বীজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। চিয়া সিড প্রদাহজনিত সমস্যাও দূর করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিয়া বীজে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। চিয়া বীজ ক্যান্সার রোধ করে, শরীরের শর্করার মাত্রা কমিয়ে হজমে সহায়তা করে। এতে থাকা উচ্চমাত্রার ক্যালশিয়াম হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যাথা দূর করে। এটি খেলে ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর থাকে। প্রচুর মাত্রায় ওমেগা থ্রি থাকার কারণে আমাদের শরীরের কোলেস্টরলকে কমিয়ে আনতেও সহায়তা করে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।