আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল, তা বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত নারীদের চুল ওড়ানো নৃত্য দেখে অনেকে বিস্মিত, কেউবা প্রশংসা করেছেন, কেউ আবার সমালোচনা। তবে এই “চুল ওড়ানো নৃত্যের ইতিহাস” ঘিরে কৌতূহল ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, এই বিশেষ নৃত্যের উৎপত্তি কোথায়? কেন এটি এত মর্যাদাপূর্ণ? এবং নারীরা কীভাবে এই নাচে যুক্ত হলেন?
Table of Contents
চুল ওড়ানো নৃত্যের ইতিহাস ও আরব ঐতিহ্যের বন্ধন
চুল ওড়ানো নৃত্যের ইতিহাস মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন এবং সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই নৃত্যটিকে বলা হয় “আই-আইয়ালা” (Al-Ayyala)। ইউনেস্কোর ২০১৪ সালের ৯ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র অনুযায়ী, এই নৃত্য শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়।
আই-আইয়ালার শিকড় মূলত বেদুইন জনপদের সাহস, সংহতি ও সম্মানের সংস্কৃতিতে। এই নাচ প্রথমে শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা বাঁশের তৈরি ছোট লাঠি হাতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মধ্যখানে থাকত ঢোলবাদক দল। গান, কবিতা ও যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দীপনামূলক শব্দের সঙ্গে তারা শরীর দোলাতেন। এই অনুশীলন ছিল এক প্রকারের প্রস্তুতি, সাহসিকতার প্রতীক।
তবে কালের পরিক্রমায় এই নাচে যুক্ত হন নারীরাও। যদিও পুরুষদের নাচে “লাঠি নাচানো” প্রধান ভঙ্গি, নারীরা তাদের চুল এদিক-সেদিক দোলানোর মাধ্যমে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাদের এই অংশগ্রহণ শুধু নান্দনিকতাই নয়, বরং পুরুষদের সাহসিকতার প্রতি তাদের আস্থা ও সমর্থনের প্রতীকও বটে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে যখন কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে, জাতীয় উৎসব বা গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে স্বাগত জানানোর প্রয়োজন হয়, তখন এই আই-আইয়ালা নাচ প্রদর্শিত হয়। ট্রাম্পের আগমনের সময়ও এই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখেই তাকে স্বাগত জানানো হয়।
চুল ওড়ানো নৃত্যের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
চুল ওড়ানো নৃত্য কেবল নান্দনিক পরিবেশনা নয়, বরং এটি নারীর আত্মপ্রকাশ, গর্ব এবং জাতিসত্তার অংশ হিসেবে বিবেচিত। মধ্যপ্রাচ্যে নারীর অংশগ্রহণকে যেভাবে প্রায়শই রক্ষণশীলতার প্রেক্ষাপটে দেখা হয়, সেখানে এই নাচ নারীর একধরনের দৃঢ় অবস্থান নির্দেশ করে।
আই-আইয়ালা নৃত্যে অংশগ্রহণকারী নারীরা সাধারণত রঙিন, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। মাথায় ঢিলা ঘোমটা থাকলেও চুল খোলা থাকে। এই খোলা চুল যখন তারা ঢোলের তালে এক পাশ থেকে অন্য পাশে দোলান, তখন সেটি হয়ে ওঠে এক অভিব্যক্তিময় দৃশ্য।
এই চুল ওড়ানো ভঙ্গির মধ্যে রয়েছে একপ্রকার স্বাধীনতার ভাষা, একধরনের আত্মপ্রকাশ। ইউনেস্কোর মতে, এই নৃত্য বেদুইন জনগোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধন, গান ও কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পুরুষ বনাম নারী – ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমার ঐক্য
এই নাচের আরেকটি আকর্ষণ হলো, পুরুষ ও নারীর ভিন্ন ভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও তারা একসঙ্গে একটি দৃশ্যমান ঐক্যের বার্তা দেয়। পুরুষরা দাঁড়িয়ে গান ও লাঠি দোলায়, আর নারীরা চুল ওড়ায়। এভাবে এই দুই লিঙ্গ একটি সমন্বিত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির জন্ম দেয়।
এই প্রথা কখনো কখনো নানা সমালোচনারও জন্ম দেয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এই নৃত্য কি নারীর স্বাধীনতা না কি শোভামাত্র? তবে আরব সমাজের বড় অংশের কাছে এটি ঐতিহ্যগতভাবে গর্বের বিষয়। তাদের মতে, এই নাচের মাধ্যমে তারা নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেন।
বিশ্ববাজারের প্রভাব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূরাজনীতি যখন আলোচনায় আসে, তখন এমন নৃত্য রাজকীয়তা ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
ঐতিহ্যগত শিক্ষার উত্তরাধিকার
আই-আইয়ালা নৃত্যের প্রধান শিল্পী নির্বাচিত হন পারিবারিক ধারাবাহিকতায়। তারা ছোটবেলা থেকে এই নৃত্যের রীতি শিখে আসেন। তাদের কাজ শুধুই পারফর্ম করা নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় স্কুল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে এটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত। বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ, যেমন ঐতিহ্যবাহী উৎসব, পর্যটন মেলা, এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। আর এই উৎসবগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ নাচটিকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করে তোলে।
প্রাচীন আগ্নেয়গিরির পেটে মিলল বিশ্বের সবচেয়ে দামি হীরার খনি!
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমালোচনা
২০১৪ সালে ইউনেস্কো এই আই-আইয়ালা নাচকে “ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ” বা অনুজ্ঞেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি শুধু মর্যাদার প্রতীকই নয়, বরং এই নাচকে সংরক্ষণে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।
তবে এই নাচের আন্তর্জাতিক পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনাও এসেছে। পশ্চিমা মিডিয়া কখনো কখনো এটিকে “লোক দেখানো” বা “রাজনৈতিক সাজসজ্জা” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। বিশেষত ট্রাম্পকে এই নাচের মাধ্যমে স্বাগত জানানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নানা প্রতিক্রিয়া উঠে আসে। কিন্তু আরব সংস্কৃতির নিরিখে এই নাচ সবসময়ই ছিল এক গর্বের প্রতীক।
আরব নারী সংস্কৃতি ও তাদের ঐতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এই নাচের সংযোগ গভীরভাবে সম্পর্কিত।
FAQs (সচরাচর জিজ্ঞাসা)
১. আই-আইয়ালা নৃত্যটি কোথা থেকে এসেছে? আই-আইয়ালা নৃত্য মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব ও বাহরাইনের বেদুইন সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এটি সাহস, সম্মান ও সংহতির প্রতীক।
২. নারীরা কীভাবে এই নাচে যুক্ত হলেন? প্রথমদিকে এটি ছিল পুরুষদের নৃত্য। পরবর্তীতে নারীরা তাদের চুল ওড়ানোর মাধ্যমে এই নৃত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেন, যা নারী আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে।
৩. আই-আইয়ালা নাচের ঐতিহ্যিক গুরুত্ব কী? এই নাচ সামাজিক বন্ধন, ঐতিহ্য, সাহসিকতা এবং জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এটি জাতির ইতিহাসের এক গৌরবময় পরিচয় বহন করে।
৪. এই নাচ কবে পরিবেশিত হয়? জাতীয় দিবস, বিয়ে, বড় পরিসরের আয়োজন, এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি অভ্যর্থনার সময় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়।
৫. চুল ওড়ানো নাচে ইউনেস্কোর ভূমিকা কী? ২০১৪ সালে ইউনেস্কো এই নাচকে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা এই নৃত্য সংরক্ষণ ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৬. এই নাচে লাঠি ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী? লাঠি ব্যবহারের মাধ্যমে পুরুষদের সাহসিকতা, ঐক্য এবং প্রস্তুতির প্রতীক হিসেবে একটি যোদ্ধার মানসিকতা ফুটে ওঠে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।