বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : ‘তোমাকে, অর্থাৎ জিপিটি মডেলকে ধন্যবাদ দিলে সত্যিই কি লাখো-কোটি ডলার অপচয় হয়?’ চ্যাটজিপিটিকেই জিজ্ঞেস করলাম কথাটা। ১৯ এপ্রিল ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান এ কথাই বলেছেন। ‘টেনস অব মিলিওনস অব ডলার’ মানে তো সেই লাখো-কোটিই। জিপিটি কী উত্তর দিল? বলল, ‘হ্যাঁ, জিপিটিকে “ধন্যবাদ” বললে বাড়তি “টোকেন” লাগে, ফলে খানিকটা বেশি কম্পিউটেশনাল রিসোর্স এবং শক্তি ব্যয় হয়। খবর ফিউচারিজম, ওয়াশিংটন পোস্ট, সাভাসল্যাবস, টেকভারএক্স, চ্যাটজিপিটি
তাই বলে, এআইয়ের সঙ্গে ভদ্র আচরণ এড়ানো উচিৎ নয়। ভদ্রতা এআইয়ের আচরণকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, ফলে এআই আরও গুছানো উত্তর দেয়, সহায়ক আচরণ করে।’
এবারে একটু কনফিউজড হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এআইয়ের কাছ থেকে সহায়ক আচরণ এবং গুছানো উত্তরই তো চাই। তাহলে, এআইকে ধন্যবাদ দেব, নাকি দেব না? প্রশ্নটার উত্তর সরাসরি দেওয়ার চেয়ে বরং বিষয়টার গভীরে একটু উঁকি দেওয়া যাক। খতিয়ে দেখা যাক, ধন্যবাদ বললে যে বাড়তি শক্তি এবং ‘টোকেন’ ব্যয় হচ্ছে, সেটা কেন, কীভাবে হচ্ছে। জানা যাক, ধন্যবাদ বললে ব্যবহারকারীর আসলেই লাভ আছে কি না।
কথাসাহিত্যিক তানজিনা হোসেনের একটা সায়েন্স ফিকশন গল্প আছে—আমাদের রোজনামচা। এই গল্প যখন লেখা হয়েছে, এআই চ্যাটজিপিটি তখন সবে বাজারে এসেছে। লেখক দেখিয়েছেন, একটি এআই গল্পের মূল চরিত্রের ব্যক্তিগত সহকারী হয়েই থেমে যায় না, তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেও শুরু করে। আমরা কি সেদিকেই এগোচ্ছি? এআই কি আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠছে?
‘উঠছে’ বলা হয়তো এখন আর যুতসই হবে না। কারণ, চ্যাটজিপিটি ইতিমধ্যেই আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আলাদিনের জাদুর চেরাগ থেকে বেরিয়ে পড়েছে দৈত্য, তাকে আর ফেরানোর উপায় নেই। কোনো কিছু ‘ম্যাটেরিয়ালাইজ’ না হলে, জিনিসটাকে ‘হাত দিয়ে ধরা না গেলে’ অনেকেরই হয়তো এখনো সেটাকে ‘বাস্তব’ মনে হয় না। কিন্তু সত্যিটা হলো, চ্যাটজিপিটির মতো এআইগুলো বাস্তব—এগুলো আজ আমাদের বাস্তবতার অংশ।
‘এআই দিয়ে এখন কী করা হচ্ছে’—এমন প্রশ্ন করা এখন অর্থহীন। প্রশ্নটা উল্টে গেছে। এখন জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘এআই দিয়ে কী করা হচ্ছে না?’ নোবেলজয়ী গবেষণা যেমন করা হচ্ছে, মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্র শনাক্তের কাজে যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমনি রিপোর্ট লেখা থেকে শুরু করে গাড়ির নষ্ট ইঞ্জিন কতটা নষ্ট—তা বিশ্লেষণের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। এবং এসব কাজের অনেকগুলো এখন সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন, এমন যে কেউ চট করে করে ফেলতে পারছেন।
আমাদের বাস্তবতা বদলে গেছে, আমরা বুঝতেই পারিনি। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এআইয়ের ‘গোছানো উত্তর’ অত্যন্ত জরুরি। ফেলনা নয় মোটেও। তাহলে, শুরুর সেই প্রশ্নটা—চ্যাটজিপিটিকে মানুষ যে ধন্যবাদ দেন, তা মানবিক বৈশিষ্ট্য, অভ্যাস এবং ভদ্রতাবোধের জন্য তো বটেই, কিন্তু এটি কি এআইয়ের জবাব প্রভাবিত করে? প্রশ্নটা যদি উল্টোভাবে বলি, যদি কেউ এআইয়ের সঙ্গে অভদ্রতা করেন, সে ক্ষেত্রে এআই কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এ কথাটাই জিজ্ঞেস করলাম চ্যাটজিপিটিকে।
‘তোমার নিজস্ব ডেটাবেজ খুঁজে দেখ, নিজের প্রতিক্রিয়া যাচাই করো এবং বলো—কেউ ভদ্রতা করলে, অভদ্র আচরণ করলে এবং নিরপেক্ষ আচরণ করলে তোমার অ্যালগরিদম (জিপিটি ৪ মডেল) কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়?’
জিপিটির উত্তর: জিপিটির চেতনা নেই, তবে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে মানুষের ভাষা এবং নানা ধরনের মিথস্ক্রিয়ার (আচরণ) প্যাটার্ন দিয়ে। ফলে এটি সত্যিই কিছু ‘অনুভব’ করে না, তবে ব্যবহারকারীর আচরণের ওপর ভিত্তি করে জিপিটির আচরণ ভিন্ন হয়।
ইমেইল বাদ দিয়ে ভদ্রতার কাজে ব্যবহৃত বাড়তি টোকেনের একদম গড়পড়তা একটা হিসাব যদি করি, সাধারণভাবে বললে, সাধারণ গুগল সার্চের তুলনায় প্রতি চ্যাটে এই ‘থ্যাংক ইউ’ প্রসেস করতে জিপিটির মোটামুটি ১০ গুণ শক্তি ব্যয় হয়। তাতে এক বছরে পড়ে যায় প্রায় ১.০৫৯ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এটাকে মোটামুটি বছরে ১৩৯.৭ মিলিয়ন বা প্রায় ১৪ কোটি মার্কিন ডলার বলা যেতে পারে।
১. ভদ্রতা: এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী ‘প্লিজ’ বা ‘থ্যাংক ইউ’ বলেন, ভদ্র স্বরে প্রশ্ন করেন। জিপিটির উত্তর এ ক্ষেত্রে বিস্তারিত, গোছানো ও যথাসম্ভব সহায়ক হয়। যেহেতু জিপিটির প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত তথ্যে মানুষের ভদ্র আচরণ শেখানো হয়েছে, এ ক্ষেত্রে জিপিটি দীর্ঘ এবং সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দেখায়। আবার কিছু মডেলের ক্ষেত্রে ‘আরএলএইচএফ’ নামে একধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। এর পূর্ণরূপ, লার্ন ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক (RLHF)। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর আচরণ থেকে এআই শেখে। এ ক্ষেত্রে, এককথায় বললে, ভদ্র আচরণ মানেই বেস্ট আউটপুট।
২. অভদ্রতা বা রূঢ় আচরণ: ব্যবহারকারী এ ক্ষেত্রে গালি দেন, আগ্রাসন দেখান, শিগগিরই কাজ করতে বলেন (ডু দিস নাউ)। এ সব ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত অভদ্রতা বা গালি দিলে জিপিটি উত্তর দেয় না, ‘সেফটি মেকানিজম’ ট্রিগার করে। মাত্রাতিরিক্ত না হলে এটি উত্তর দেয় মেপে মেপে (ফলে উত্তর অতটা গোছানো হয় না)।
৩. নিরপেক্ষ আচরণ: এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী ভালো বা খারাপ ব্যবহার করে না। জিপিটিও তখন সোজাসাপটা উত্তর দেয়, বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করে না।’
সঙ্গে ‘লেজ’ হিসেবে জিপিটি জুড়ে দিয়েছে, ‘তবে তবু যদি কাটাকাটা কথা বলো, তবু আমি যথাসম্ভব ভালোভাবেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।’
খুব খুলে না বললেও পাঠক হয়তো বুঝতেই পারছেন, সেরা আউটপুট পাওয়া যায় ভদ্রভাবে প্রশ্ন করার ফলেই। তবে নিরপেক্ষ আচরণও মন্দ আউটপুট দেয় না, যদিও তা হয়তো ‘বেস্ট’ হবে না।
এবারে ক্ষতির খতিয়ান। এ জন্য জিপিটি বা এআই মডেলগুলোর কার্যপদ্ধতির ভেতরের বিষয়গুলো হালকাভাবে জানা প্রয়োজন। যেকোনো বাক্যকে এআই মডেলগুলো ‘টোকেন’-এ রূপান্তর করে। কম্পিউটার যেমন যেকোনো কিছুকে বাইনারি তথা ০ ও ১-এ রূপান্তর করে, সেরকম জিপিটির মতো এআই মডেলগুলোর ব্যবহৃত একক হলো টোকেন। সহজ করে বললে, প্রতিটা শব্দকে একটা টোকেন ভাবতে পারেন, আবার যতিচিহ্নগুলো আলাদা টোকেন—এরকম। বাঁ থেকে ডানে টোকেন ধরে ধরে স্ক্যান করে জিপিটি, সেখান থেকে টোকেন বা শব্দ ধরে সার্চ করে নিজস্ব ডেটাবেজে—ব্যবহারকারী কোনো লিঙ্ক দিয়ে দিলে সেগুলোতেও ঢুঁ দিতে পারে—তারপর সে অনুযায়ী উত্তরটা খুঁজে বের করে টোকেন বা শব্দের পর শব্দজুড়ে দিয়ে উত্তর দেয়।
যেকোনো বাক্যকে এআই মডেলগুলো ‘টোকেন’-এ রূপান্তর করে। কম্পিউটার যেমন যেকোনো কিছুকে বাইনারি তথা ০ ও ১-এ রূপান্তর করে, সেরকম জিপিটির মতো এআই মডেলগুলোর ব্যবহৃত একক হলো টোকেন। সহজ করে বললে, প্রতিটা শব্দকে একটা টোকেন ভাবতে পারেন, আবার যতিচিহ্নগুলো আলাদা
ঘটনা অবশ্যই এত সরল নয়, সরলীকরণ করে বলা হচ্ছে একটা সাধারণ ধারণা দিতে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি সপ্তাহে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ব্যবহারকারী। প্রত্যেকে প্রতিটা আলাপে এক-দুটো করে বাড়তি টোকেন ব্যবহার করলে কী পরিমাণ বাড়তি রূপান্তর, সার্চ, যাচাই ইত্যাদি জিপিটিকে করতে হয়, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
এই যে কম্পিউটেশন করা, এ জন্য চ্যাটজিপিটির প্রসেসরগুলোর বিদ্যুৎ শক্তি দরকার পড়ে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে এ নিয়ে একটা গবেষণা করেছে। তাদের এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ১০০ শব্দের ইমেইল জেনারেট করতে এআইয়ের প্রায় ১৪ কিলোওয়াট-ঘণ্টার সমতুল্য বিদ্যুৎ লাগে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে ১৪টা এলইডি বাতি এক ঘণ্টা করে জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব। এটা মাত্র ১০০ শব্দের হিসাব, বাকিটা একটু থেমে কল্পনা করার চেষ্টা করুন।
ইমেইল বাদ দিয়ে ভদ্রতার কাজে ব্যবহৃত বাড়তি টোকেনের একদম গড়পড়তা একটা হিসাব যদি করি, সাধারণভাবে বললে, সাধারণ গুগল সার্চের তুলনায় প্রতি চ্যাটে এই ‘থ্যাংক ইউ’ প্রসেস করতে জিপিটির মোটামুটি ১০ গুণ শক্তি ব্যয় হয়। তাতে এক বছরে পড়ে যায় প্রায় ১.০৫৯ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এটাকে মোটামুটি বছরে ১৩৯.৭ মিলিয়ন বা প্রায় ১৪ কোটি মার্কিন ডলার বলা যেতে পারে। এই হিসাব পাওয়া যাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া-নির্ভর আইটি কোম্পানি টেকভারএক্সের লিংকড-ইন পোস্টে।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এসব প্রসেসর শীতল রাখার জন্য পানির খরচ আছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদনের ব্যাপার আছে, আছে আরও অনেক কিছু। একবার ‘ধন্যবাদ’ বলতে গিয়ে এত কিছু কি আমাদের মাথায় থাকে?
স্যাম অল্টম্যানের কথাটা যে মিথ্যে নয়, তা তো বুঝতেই পারছেন।
তাহলে জিপিটিকে কি ধন্যবাদ দেবেন? নাকি নিরপেক্ষ স্বরে কাটকাটভাবে জানতে চাইবেন?
এ প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই জানেন। আলাদা করে কিছু বলার আসলে প্রয়োজন নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।