জুমবাংলা ডেস্ক : শ্রেণিকক্ষে ছাত্রকে গুলি করে দেশব্যাপী আলোচিত শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফ। এ কাণ্ডের পর তাঁর ব্যাগ তল্লাশি করে দুটি অবৈধ পিস্তল, ৮১টি গুলি ও ১০টি চাকু উদ্ধার করেছে পুলিশ। এখানেই শেষ নয়, অস্ত্রের প্রতি তাঁর নেশা অনেক পুরোনো। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার সময়ই তিনি ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষক হয়েও হাতে কলমের বদলে থাকত অস্ত্র ও ছুরি। এ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সমকাল।
এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ সরকারি শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের এ প্রভাষকের বিরুদ্ধে রয়েছে যৌন হয়রানি, মাদক সেবনসহ নানা গুরুতর অভিযোগ। এদিকে, শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা এবং অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ডা. রায়হানের বিরুদ্ধে গত সোমবার রাতে সিরাজগঞ্জ থানায় দুটি মামলা করা হয়েছে।
গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীর বাবা বগুড়ার জেলা সদরের ধানসিঁড়ি নাটাইল গ্রামের সাবেক সেনা সদস্য আবদুল্লাহ আল আমিন ছেলেকে হত্যার চেষ্টা এবং ডিবির উপপরিদর্শক ওয়াদুত আলী বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে মামলা দুটি করেন।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম বেল্লাল হুসাইনের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন অভিযুক্ত শিক্ষক। জবানবন্দিতে অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে জানান ডিবির ওসি জুলহাজ উদ্দিন। এখন তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে আছেন।
ডিবির ওসি আরও জানান, শিক্ষক রায়হান শরীফের ব্যাগ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড তাজা গুলি, একটি গুলির খোসা, চারটি ম্যাগাজিন, দুটি বিদেশি কাতানা (ছোরা) ও ১০টি অত্যাধুনিক বার্মিজ চাকু উদ্ধার করা হয়েছে।
ছাত্রাবস্থায়ই ছিল অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক
সিরাজগঞ্জ থেকে ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক) এমবিবিএস শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন ডা. রায়হান শরীফ। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে ছিলেন তিনি। সে সময় রামেকের পিঙ্কু হোস্টেলে থাকতেন। তখন থেকেই আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। বিভিন্ন সময়ে এসব অস্ত্র কিনে সংগ্রহে রাখতেন। ডিবি পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দেন এ চিকিৎসক।
২০১৬ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। ২০১৯ সালের ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রকল্পে চাকরি করেন। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২ সালে তিনি রাজশাহীর গোদাগাড়ির প্রেমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের ২২ মার্চ সিরাজগঞ্জ সরকারি এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কমিউিনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। যোগদানের পরপরই তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিভিন্ন সময় সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের প্রতি রূঢ় আচরণ এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে আসায় শিক্ষার্থীরা সবাই তাঁকে ভয় করতেন। আলোচিত শিক্ষক রায়হান মাদক বা অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিনা, সে আলোচনাও শুরু হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের যত অভিযোগ
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মারুফ জানান, প্রায়ই তিনি অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে আসেন। অনেক সময় টেবিলের ওপর ওইসব অস্ত্র রেখে ক্লাস নেন। সুযোগ পেলে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন। তাঁকে দেখে সাইকো মনে হয়েছে।
একই বর্ষের শিক্ষার্থী ফাইমুদ্দিন ফাহিম বলেন, এমন শিক্ষক আমরা জীবনে দেখিনি। সামান্য বিষয়ে তিনি গুলি করার ভয় দেখান। অন্য শিক্ষার্থী রিফাত পাঠান বলেন, অসময়ে আইটেম ক্লাস নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করার প্রতিবাদ করায় সহপাঠী আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করার ঘটনায় আমরা খুবই হতবাক হয়েছি।
জাহিন শাহরিয়া বলেন, তমালকে গুলি করার পর যখন ছটফট করতে থাকে, তখন আমরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন শিক্ষক রায়হান তাকে হাসপাতালে নিতে বারণ করেন। হাসপাতালে নিলে আমাদেরও গুলি করা হবে বলে ভয় দেখান। আমরা বাধ্য হয়ে তখন ট্রিপল নাইনে ফোন করি।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
এ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের ব্যাগ থেকে সোমবার বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র-গুলি ও চাকু উদ্ধার করে পুলিশ। আমি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানাব।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার জীবনে এমন ঘটনা দেখিনি। বিষয়টি সত্যিই বিব্রতকর। বিষয়টি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ তদন্ত কমিটির
শিক্ষকের গুলিতে শিক্ষার্থী আহতের ঘটনায় অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। গতকাল সকালে মেডিকেল কলেজে এসে ভিকটিম শিক্ষার্থী, তাঁর সহপাঠী ও অভিযুক্ত শিক্ষকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক রায়হানের কাছে দীর্ঘদিন ধরে নিবন্ধনহীন দুটি পিস্তল ও বেশ কয়েকটি ছুরি ছিল। এর আগেও শিক্ষার্থীদের এসব অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুলির ঘটনার আগে অধ্যক্ষের অফিসে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ জমা পড়ে। তবে অধ্যক্ষ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি। ছাত্রকে গুলি করার কথা তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করে এই শিক্ষক বলেছেন, অনিচ্ছাকৃতভাবে গুলি করা হয়েছে।
মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ
অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তি দাবিতে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে কলেজের সামনে মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ কারণে সড়কের দুই পাশে যানজট দেখা দেয়। খবর পেয়ে ডিবি পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেওয়ায় দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা কলেজে ফিরে যান। এ ঘটনার পর সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তি ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দেন তিনি।
দুই অস্ত্র কেনায় ব্যয় আড়াই লাখ টাকা
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীকে গুলি, অবৈধ পিস্তলের ব্যবহার এবং প্রভাষক রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে ওঠা শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতন ও কলেজ অভ্যন্তরে নেশা-সংক্রান্ত সব বিষয় পর্যায়ক্রমে তদন্ত করা হবে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলাই ডিবি পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে জব্দকৃত দুই পিস্তল অবৈধ। তিনি কীভাবে অস্ত্র দুটি কিনলেন, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। বিষয়টির তদন্ত চলছে। তাঁকে দেখে আপাতত সাইকো বলেই মনে হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মাস তিনেক আগে প্রথমে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের একটি নতুন অস্ত্র কেনেন ওই শিক্ষক। এর কয়েক দিন পর একই ব্র্যান্ডের আরেকটি অস্ত্র কিনেছেন। দুটি অস্ত্র কেনায় তাঁর ব্যয় হয় আড়াই লাখ টাকা। অবৈধ অস্ত্রের কারবারের সঙ্গে জড়িত একটি গ্রুপের কাছ থেকেই তিনি অস্ত্র ও ৮১ রাউন্ড গুলি কেনেন। প্রতি গুলির পেছনে তাঁর খরচ হয় ২ হাজার টাকা।
কেন অস্ত্র কিনেছেন– এমন প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষক পুলিশকে জানান, অস্ত্র-গুলি সংগ্রহ করা তিনি ‘ফ্যাশন’ মনে করতেন। প্রয়োজন হলে কাউকে ভয় দেখানোর লক্ষ্য ছিল তাঁর। এমনকি সাত-আট বছর ধরে ইয়াবাসহ মাদক সেবন করতেন শিক্ষক রায়হান শরীফ। এ ছাড়া বাজার থেকে কিনেছেন ১২টি বিদেশি চাকু।
কেন ওই ছাত্রকে গুলি করতে গেলেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে প্রশ্ন করায় ওই শিক্ষার্থী হাসাহাসি শুরু করে। এরপর আর রাগ ধরে রাখতে পারেননি।
সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুলিশের এখন মূল টার্গেট হলো যে গ্রুপের কাছ থেকে ওই শিক্ষক অস্ত্র-গুলি কিনেছেন, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা।
এর আগে সোমবার বিকেলে মেডিকেল কলেজের অষ্টম ব্যাচের আইটেম ক্লাস চলাকালীন বাগ্বিতণ্ডার জেরে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করেন কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক রায়হান শরীফ। সন্ধ্যার পর তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলি বের করেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। অভিযুক্ত শিক্ষক সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। শহরের বিএ কলেজ রোডে প্রফেসরস কোয়ার্টারের বাসিন্দা। গতকাল দুপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি, মোবাইল ফোনেও সাড়া দেননি পরিবারের কেউ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।