ছোট সোনামসজিদ: প্রাচীন গৌড় নগরীর স্থাপত্য রত্ন

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০-২৮৩ অব্দে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কামরূপের সঙ্গে গৌড় রাজ্যেরও নাম পাওয়া যায়। গৌড় বাংলার এককালীন রাজধানী এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি নগর, যার অবস্থান বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। এটি লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই দুর্গনগরীর অধিকাংশ পড়েছে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলায় এবং কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। ছোট সোনামসজিদ রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানায় পড়েছে।

ছোট সোনামসজিদ

অতীতে ছোট সোনামসজিদের বাইরের দিকে সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল। সূর্যের আলো পড়লে সেই রং সোনার মতো ঝলমল করত। সে জন্য এর নাম হয়েছে সোনামসজিদ। প্রাচীন গৌড় নগরীতে সুলতান নুসরত শাহ অনেকটা একই রকম আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তবে সেটি ছিল আরো বড়। তাই স্থানীয় লোকজন গৌড় নগরীর মসজিদটিকে বলত বড় সোনামসজিদ আর নগরীর বাইরে থাকা এই মসজিদকে বলত ছোট সোনামসজিদ। বাংলাদেশের ২০ টাকার নোটে ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদের ছবি আছে।

মসজিদের মাঝের দরজায় যে শিলালিপি রয়েছে সেখান থেকে জানা যায়, ওয়ালী মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদের শিলালিপিতে নির্মাণকালের জায়গা অনেকটাই মুছে যাওয়ায় সঠিক সাল জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, সুলতান হোসেন শাহের আমলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯–এর মধ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি ‘হোসেন শাহ স্থাপত্য রীতি’তে নির্মিত।

ছোট সোনামসজিদ উত্তর–দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা, পূর্ব–পশ্চিমে সাড়ে ৫২ ফুট চওড়া। মসজিদের উচ্চতা ২০ ফুট, দেয়ালগুলো ৬ ফুট পুরু। মসজিদের মূল কাঠামো ইটের তৈরি হলেও বাইরের ও ভেতরের আবরণ গ্রানাইট পাথরের। মসজিদের চার কোনায় আছে চারটি বুরুজ, যা অষ্টকোণাকৃতির। ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত উঁচু বুরুজগুলো ধাপে ধাপে নকশা করা। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে পাঁচটি খিলানযুক্ত দরজা আছে, যার মধ্যে রয়েছে অনেক ভাগ, যা সুন্দর নকশা–সংবলিত। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে তিনটি করে দরজা।

উত্তর দেয়ালের সর্ব পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে একটি দ্বিতল সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়ে মসজিদের ভেতরে একটি বিশেষ কক্ষে যাওয়া যায়, যা পাথরের স্তম্ভের ওপর অবস্থিত। গঠন অনুসারে একে ‘জেনানা মহল’ বা নারীদের নামাজের স্থান হিসেবে ধারণা করা হয়। কিন্তু অনেকের মতে, সুলতান বা শাসনকর্তার নির্বিঘ্নে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল।

মসজিদের ভেতরে কালো বেসল্টের মোট আটটি স্তম্ভ রয়েছে। উত্তর–দক্ষিণে তিনটি আইল ও পূর্ব–পশ্চিমে পাঁচটি সারিতে বিভক্ত। পূর্ব দেয়ালের পাঁচটি দরজা বরাবর পাঁচটি মিহরাব আছে, যার মধ্যে রয়েছে পাথরের অলংকরণ। সবচেয়ে উত্তর দিকে দুই তলার কামরাটির জন্য রয়েছে একটি মিহরাব। মসজিদের আটটি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর নির্মিত হয়েছে ১৫টি গম্বুজ। এর স্থাপত্য এমন গাণিতিক হিসাবে করা যে আপনি বাইরে থেকে যেকোনো দিক থেকেই তাকান না কেন, পাঁচটি গম্বুজ একবারে দেখা যায়। মাঝের গম্বুজটি বাংলার চৌচালা ঘরের আদলে তৈরি

সোনামসজিদের অলংকরণে মূলত পাথর, টাইলস, ইট ও টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে। পাথর খোদাইয়ের কাজ লক্ষণীয়। মসজিদের সামনের দরজা ও বুরুজে পাথরের মিহি নকশা ব্যবহার করা হয়েছে। ছোট সোনামসজিদের আঙিনায় ঢোকার পথে একটি সুন্দর তোরণ রয়েছে, যার অবস্থান মসজিদের মাঝের দরজা বরাবর। এই তোরণের সঙ্গে মসজিদের চারপাশে পাঁচিল ছিল, যার সম্পূর্ণই এখন বিলুপ্ত। এর পরিবর্তে রয়েছে কাঁটাতারের বেষ্টনী। মসজিদের পাশেই আছে উঁচু স্তম্ভের ওপর দুটি কবর, ধারণা করা হয় এই কবর দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মোহাম্মদ আলী ও তাঁর স্ত্রীর। এটাও ধারণা করা হয় যে এই দুটি কবর ওয়ালী মোহাম্মদ আলী ও তাঁর বাবা আলীর।