বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগলের দৃঢ়তা এত বেশি ছিল যে এটিকে অজেয় হিসেবেই মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ‘জেনারেশন জেড’, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এবং চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে যাদের জন্ম, তাদের কাছে গুগলের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমে আসছে। বিকল্প হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে টিকটককে!
একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মের কাছে গুগলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি গুগল কর্তৃপক্ষেরও চোখ এড়ায়নি। প্রতিষ্ঠানটির একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রভাকর রাঘবন জানিয়েছেন, তাদের অভ্যন্তরীণ গবেষণা অনুযায়ী, জেনারেশন জেড এর ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য গুগলের পরিবর্তে ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে সার্চ দেয়।
২২ বছর বয়সী টিকটক ব্যবহারকারী রোজা রদ্রিগেজ বলেন, “আগে যখন আমার কোনো বিষয়ে সন্দেহ থাকতো, আমি গুগলের কাছে ছুটতাম। কিন্তু এখন আমি টিকটকে সেই তথ্য খুঁজি। টিকটকের কন্টেন্টগুলোর মানের কারণেই আমি তাদের উপর বেশি ভরসা রাখি। শুধুমাত্র যখন টিকটকে আমি আমার মনমতো তথ্য পাই না কিংবা একেবারেই খুঁজে পাই না, তখন গুগলের শরণাপন্ন হই… আর সত্যি কথা হচ্ছে, এমনটা খুব কম সময়ই হয়।”
রদ্রিগেজের মতো আরও লাখ লাখ তরুণ-তরুণী গুগলের বদলে এই চীনা প্ল্যাটফর্মটির দিকে ঝুঁকছেন। তবে টিকটক পছন্দ করার একটি প্রধান কারণ হলো- এর গতিশীলতা। আরেকটি কারণ হলো- কোনো টেক্সট পড়ার চাইতে টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে মাত্র কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটেই সবকিছু বুঝে নেওয়া যায়।
সোশ্যাল মিডিয়া কনসালটেন্ট এবং ‘টিকটক বুক’-এর লেখিকা ফাতিমা মার্তিনেজ জানিয়েছেন কেন টিকটক ইন্টারনেট জগতে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।
মার্তিনেজ বলেন, “এই প্রজন্মটা তাদের আগের প্রজন্মের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। টিকটক আপনাকে এক মিনিটের ভিডিও দিবে, যেখানে ফুলস্পিডে আপনার যা যা তথ্য প্রয়োজন তা দেখিয়ে দেওয়া হবে।
উদাহরণস্বরূপ- রেস্টুরেন্ট নিয়ে যদি গুগলে কিছু খুঁজতে যান, তাহলে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট নিয়ে মানুষের মতামত এবং গুটিকয়েক ছবিও দেখতে পাবেন। কিন্তু টিকটকে ঐ রেস্টুরেন্টগুলোতে কারা গিয়েছেন, খাবারের মান কেমন, রেস্টুরেন্টের পরিবেশ কেমন, কিভাবে তারা খেয়েছেন- এই সবকিছুর ভিডিও দেখতে পাবেন। এ প্রজন্মের তরুণেরা সবকিছুর ভিজ্যুয়াল দেখতে অভ্যস্ত, তথ্য খোঁজার বেলায় তারা খুব অলস।”
তবে কমপ্লিউটেন্স ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদ-এর অধ্যাপক উবালদো কুয়েস্তা মনে করেন, এই ট্রেন্ড আসলে শুধুমাত্র তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজিত নয়। তার ভাষ্যে, “যেমনটা পোলিশ দার্শনিক বাউম্যান বলেছিলেন- আমরা ‘লিকুইড মডার্নিটি’ ও অগভীর চিন্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এটা কেন হচ্ছে? প্রথমত, চিন্তা করলে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার বদলে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকাকে সে ভালো মনে করে, তাই নয় কী? চিন্তাচেতনায় পরিপূর্ণ একটা সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে একটা ‘লিকুইড সমাজের’ দিকে এগিয়ে যাওয়া সহজ, যেখানে ক্রমাগত গতিশীলতা ও পরিবর্তন ঘটছে।”
কুয়েস্তা বলেন, তরুণরা এখন এমন অবস্থায় রয়েছে- ইতালিয়ান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জিওভান্নি সারতোরির ভাষায় যারা ‘হোমো ভাইডেন্স’, অর্থাৎ যারা কিনা ছবির মাধ্যমে বাঁচে! আমাদের মস্তিষ্ক চাক্ষুষ জিনিসগুলোর উদ্দীপনায় ভালো সাড়া দেয় এবং সে কারণে টেলিভিশন, টিকটকের মতো প্রযুক্তি সহজেই আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়।”
এদিকে, ভিডিও দেখার জন্য ইউটিউব একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম হলেও, সাধারণত লম্বা সময়ের ভিডিওগুলো এতটা উচ্চগতিতে দেখানো হয় না ইউটিউবে। ‘সংক্ষিপ্ততা’ টিকটকে আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। টিকটকে ১০ মিনিটের কোনো ভিডিও খুঁজে পাওয়াই কঠিন; সাধারণত এই প্ল্যাটফর্মের ভিডিওগুলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের হয়।
মার্তিনেজ মনে করেন, “শিশুরা বাস্তব জগত থেকে দূরে পালিয়ে থাকতে চায় কারণ তারা এটা পছন্দ করে না এবং এখানে কোনো ভবিষ্যত খুঁজে পায় না। তার আসলে ‘ভবিষ্যত’ সম্পর্কে অতটা আগ্রহীও নয়। তার চেয়ে বরং তারা বর্তমান নিয়েই থাকতে বেশি ভালোবাসে… তারা সবকিছুই খুব দ্রুতগতিতে চলছে দেখতে অভ্যস্ত।”
সফটওয়্যার ডেভলপার হাবস্পট-এর ডেটা অনুযায়ী, জেনারেশন জেড টেক্সট বা লেখা এবং অন্যান্য গতানুগতিক পদ্ধতির চাইতে ভিডিওর মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় শিখতে ও জানতে পছন্দ করে। সেই সাথে তারা প্রতিটি কন্টেন্টের দিকে গড়ে আট সেকেন্ড সময় দেয় বলে জানা গেছে।
অধ্যাপক কুয়েস্তা মনে করেন, তরুণদের এই অভ্যাসের সাথে ‘কার্পে ডিয়েম’ এবং বৈচিত্র্যতা অন্বেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অফকম-এর একটি গবেষণা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে তরুণ ও টিনেজারদের কাছে শীর্ষ ৩টি তথ্যের উৎস (শুধু বিনোদনের জন্যই নয়) হলো ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং ইউটিউব।
তবে ১৯ বছর বয়সী টিকটক ব্যবহারকারী হোসে লুইস সানজ ভিন্নমত পোষণ করে জানান, তিনি এখনো সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগল ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে খেলার সংবাদ পড়েন। শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা জানতে হলে বা কোনো পণ্যের রিভিউ দেখতে চাইলে তিনি ভিডিও দেখেন।
সানজ অকপটেই স্বীকার করেন, “আমি গতানুগতিক ধারায়ই আছি এখনো।” সানজের মতো ১৬ বছর বয়সী টিকটক ব্যবহারকারী সোফিয়াও এখনো তথ্য খুঁজতে গুগল ব্যবহার করেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে রদ্রিগেজ জানান, তিনিও বিশ্বাস করেন যে গতানুগতিক সার্চ ইঞ্জিনের চেয়ে টিকটকে তাৎক্ষণিকতা ও নৈকট্য বেশি। তার ভাষ্যে, “টিকটকের কন্টেন্টগুলোতে (ভিডিও) অনেক বেশি সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং গুগলের কিছু লেখার চাইতে এগুলো বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে।”
তবে অধ্যাপক কুয়েস্তা বলেন, টিকটক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ‘মূল্যায়নের বিভিন্ন পরিমাপক’ রয়েছে (যেসব ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন জিনিসের রিভিউ করেন) যা ‘বর্তমানের সমাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ’, যেখানে তরুণরা কোনো কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করে না মানুষ, বরং একজন বন্ধুকে বিশ্বাস করে। জেনারেশন জেড-এর তরুণ-টিনেজাররা চায়, কেউ একজন ক্যামেরার সামনে এসে সংক্ষিপ্ত আকারে কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করুক, যেন ক্যামেরার সামনের মানুষটি তার বন্ধু বা পরিচিত।
মার্তিনেজ আরও উল্লেখ করেন, টিকটকের কন্টেন্টগুলো শক্তিশালী করে তোলার পেছনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ভূমিকা রয়েছে, যার ফলে ব্যবহারকারীদের মনমানসিকতা একেবারে বদলে যায়। তিনি বলেন, “টিকটক আপনাকে তাই দেখাবে যা আপনি দেখতে চান। এটা একদম নেশার মতো এবং এটা এভাবেই বানানো হয়েছে যে আপনি ফুলস্পিডে ভিডিওগুলো স্ক্রল করে যাবেন। গুগলের এখন এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।