মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ: বিশ্বে বায়ুদূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে আবারও শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের চেয়ে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা সবসময় অনেক বেশি থাকে, যা কখনো সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে ছয় গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর’ ছিল সকাল ও দুপুরে যথাক্রমে ৩৭৪ এবং ৩৪৯, যাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণের মাত্রা। পুরো ডিসেম্বর মাসে বায়ুদূষণের মান খারাপ লক্ষ করা যায় এবং দিনের চেয়ে রাতের বেলায় দূষণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। শুষ্ক ঋতু হওয়ায় শীতকালে ধুলাবালির সঙ্গে মিশে থাকে সিমেন্ট কারখানার ধুলা ও ইটভাটার ধোঁয়া। সঙ্গে শিল্পকারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ধোঁয়া মিশ্রিত হলে দূষণের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে।
ঢাকার বায়ুমান ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকায় একিউআই স্কোরকে সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে গণ্য করা হয়। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের’ মতে, মানবদেহের জন্য দূষণের অসহনীয় উপাদান মাত্রা পিএম-২.৫ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বাস করছে। আবার বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এমনকি বায়ুদূষণের ফলে তিন বছর করে কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু। অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির ৪ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত থাকে এবং গত চার বছর ধরে ঢাকার বাতাসে দূষণের ব্যাপ্তি ধারাবাহিকক্রমে বেড়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুশন’ বায়ুর মানের দিক থেকে এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা দিয়েছে। বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু শ্বাসজনিত জটিল সমস্যার শিকার হয়। বায়ুদূষণে বেড়ে চলেছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ এবং বিষণ্নতার মতো শারীরিক সমস্যা। বয়স্ক ও রোগাক্রান্ত মানুষসহ পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুরা হয় বায়ুদূষণের নির্মম শিকার।
ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর নবজাতক থেকে পাঁচ বছর বয়সী ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট বাতাসে সূক্ষ্মকণার মধ্যে রয়েছে অজৈব এবং জৈব বস্তু—যেমন ধুলোবালি, কালো ধোঁয়া, ড্রপলেট ও ফুলের রেণু। ঢাকার বায়ুদূষণে মূলত শহরের বড় প্রকল্প ও ভবন নির্মাণের কাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়াই দায়ী। ধুলোবালির দূষিত অংশ বাতাসের নিম্নস্তরে ২০০-৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে অবস্থিত ধূলিকণার দূষণে জন্মের প্রথম মাসে বিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয় বলে মন্তব্য করেছে বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা কিছু সংস্থা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার এয়ারভিজ্যুয়াল’ এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিনপিস’-এর ২০১৮ সালের গবেষণায় বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বাতাসে ‘পিএমটু-পয়েন্টফাইভ’ নামের এক ধরনের সূক্ষ্মকণার উপস্থিতির যে মাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে, তাতে মানুষের জীবন সংহার হতে পারে। বায়ুদূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা ব্যয় পড়ছে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন ডলার। ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিকে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এমনকি বায়ুদূষণ মানবকুলের জীবিকা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস মহানগরীর আশপাশের ইটভাটা। এ ছাড়া রাস্তাঘাটের ধুলা, মোটরগাড়ি ও কলকারখানার দূষণ মিলে ২৬ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটায়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেবে পাঁচ বছর আগেও এই তিন খাতে বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ১৫ শতাংশ। রাজধানী ঢাকার বাতাসে মিশ্রিত আছে নানা ধরনের সূক্ষ্ম রাসায়নিক বস্তুকণাসহ কার্বন-ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার, অ্যামোনিয়া, ফটো-কেমিক্যাল অক্সিডেন্টস।
এসব ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপকহারে নিঃসরণ শহরে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠীর ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে শুরু করে স্ট্রোক, হৃদযন্ত্র ও অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ব্যাধির কারণ হতে পারে। ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার থাকার ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত ও স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। নারীর গর্ভপাত, মৃতশিশু প্রসবের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের কারণে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। সড়ক ও ভবন নির্মাণকালে রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ধুলা। গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ টন ধুলোবালি জমছে। উন্মুক্ত ট্রাকে নির্মাণসামগ্রী বহনকালে উড়ছে ধুলা। গত ৪০ বছর ধরে ঢাকা শহরে সুউচ্চ ভবন নির্মাণসহ অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও নন-কমপ্লায়েন্স শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ। বিক্ষিপ্ত নগরায়ণের কারণে ৭৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বনভূমি উজাড়ের কারণে বাতাসে বাড়িয়ে তুলছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইডের মাত্রা, যা পক্ষান্তরে বাতাসকেই দূষিত করছে। জাতিসংঘের মতে, ব্যাপক বৃক্ষরোপণের পরও গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি। এ হিসাবে প্রতি মিনিটে হারিয়ে যাচ্ছে ৮ হেক্টর বন। বাংলাদেশে গড়ে ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৩০ হাজার বৃক্ষ নিধন হলেও এর বিপরীতে রোপণ হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার বৃক্ষ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর।
কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া বাতাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন-মনোক্সাইডের বিস্তার ঘটায়। এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণীদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসবেস্টস আঁশ, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্প্রের কণা বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটায়। চামড়া শিল্প, রং কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়ঃশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইড জীবজগতের অস্তিত্বের ওপর হুমকিস্বরূপ।
শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, প্লাস্টিক ও বিস্ফোরকদ্রব্য প্রস্তুত কারখানা থেকে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে এবং পানিতে মিশ্রিত হয়ে বিষাক্ত নাইট্রিক অ্যাসিডে পরিণত হয় এবং নিকটবর্তী এলাকার বাতাসকে দূষিত করে। এ ছাড়া ধাতু গলানো কারখানা, কয়লা-পেট্রোল-কেরোসিনের মতো জ্বালানির সালফার বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে সালফার-ডাইঅক্সাইড সৃষ্টি করে যা অ্যাসিড বৃষ্টির কারণ। সুপার-ফসফেট কারখানা থেকে নির্গত হাইড্রোজেন-ক্লোরাইড বাতাসে মিশে প্রাণীদেহের হাড়ের ক্ষতিসাধন করে। বাতাসকে দূষণমুক্ত রেখে সুস্থ জীবনযাপনের জন্য নির্মাণাধীন ভবন ও রাস্তাঘাট থেকে উৎপন্ন ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পকারখানাকে শহর থেকে দূরে স্থাপন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পবর্জ্যের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাসহ যানবাহনে সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। ইটের ভাটা স্থাপন এবং ভাটায় চিমনি ব্যবহারের মাধ্যমে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়ম মেনে চলার নিশ্চয়তা বিধান অত্যাবশ্যক। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন বন্ধ করা জরুরি। বাংলাদেশের বায়ুদূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ভূমিকা অত্যাবশ্যক। রাজধানীসহ সারা দেশের বায়ুদূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা ও আপামর জনগণের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।