মো. রাকিবুল ইসলাম: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য-প্রভাব নিয়ে করা তাদের গবেষণা রিপোর্টে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, সে সম্বন্ধে উল্লেখ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরনে পরিবর্তন আসবে; তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে; জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে। তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে শারীরিকভাবে আহত হচ্ছেন শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধরা। এছাড়া বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শিশুরা মানসিকভাবেও হয়ে পড়ছে পর্যুদস্ত।
বিপুল মানুষ নিজস্ব আবাস ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবনে পদার্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে গর্ভবতি মায়েদের জীবনে। তারা পাচ্ছেনা ন্যূনতম স্বাস্থ্য-সুবিধা, ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালনের কারণে অনায়াসেই সন্তানের শরীরে জায়গা করে নিচ্ছে নানা রোগব্যাধী। এছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে বয়ঃসন্ধিকালে, কিশোর-কিশোরীরা পাচ্ছেনা উপযুক্ত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যারা বাধ্যতামূলক অভিবাসনের শিকার হচ্ছে তাদের অধিকাংশই জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে শহরমুখী হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাদেরকে আশ্রয় নিতে হচ্ছে বিভিন্ন বস্তিতে। যেখানে নেই জীবন-ধারনের ন্যুনতম সুযোগ-সুবিধা। রয়েছে চমম মাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি। যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা এবং জলাবদ্ধতাসহ একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে কয়রা, সাতক্ষীরা প্রভৃতি এলাকার বাস্তুহারা মানুষের মধ্যে ‘গণ-হতাশা’ নামক মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। স্থায়ী বসতিতে ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারলে এই রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে বলে চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে খুলনা এলাকায় লোনা পানির দাপটে নদীর পানিও লোনা হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সে পানি পান করায় ঐ এলাকার মানুষের মাঝে দেখা দিচ্ছে নানারকম পেটের পীড়া, চর্মরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের মতো মারাত্মক ব্যাধি। এসব কারনে সহায়-সম্বলহীন মানুষ ছাড়াও অবস্থাসম্পন্ন মানুষরাও বাধ্য হচ্ছে তাদের পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে বসতি গড়তে। এতে তাদের মধ্যে মানসিক রোগের পাশাপাশি নানাবিধ শারিরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ডায়রিয়ার জীবাণুর বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে এবং ডায়রিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে। সংস্থাটির এক গবেষণায় জানা যায়, ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু নীলাভ-সবুজ শ্যাওলা আঁকড়ে পানিতে ভাসে, এবং তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে শ্যাওলা বাড়ার সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে এপ্রিল-মে -এই দুই মাসে এবং সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর এই চার মাসে ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে শ্যাওলা বাড়ার সাথে সাথে হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
এছাড়া, আকাশে মেঘ কম থাকলে প্রখর সূর্যের আলো সালোকসংশ্লেষণে সহায়ক বলে শ্যাওলা আরো বেড়ে যায়। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাবে ট্র্যাকোমা-জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে; যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
অ্যাকশন এইড-এর এহ সমীক্ষায় জানা যায়, সাতক্ষীরার দাকোপসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনাপানি ঢুকে পড়েছে, ফলে লোকজনকে, পানি ও খাবারের সাথে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে ঐসকল এলাকার লোকজন উচ্চ রক্তচাপ রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে লবণাক্ততায় আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের প্রি-একলেম্পশিয়া ও উচ্চরক্তচাপের হার ৬.৮ শতাংশ যা ফেব্রুয়ারি মাসে ঐ এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায় বলে পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৯.৫ শতাংশে।
এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণে মশার প্রজনন বেড়ে যায়, এবং তাদের বংশবৃদ্ধির সময় দীর্ঘায়িত হয়। ফলে মশাবাহিত নানা রোগ, বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। নারীর স্বাস্থ্যের ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নারীদের মধ্যে জরায়ু ও প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ বেশি খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা জানিয়েছেন, উপকূলবর্তী এলাকার নারীদের মাসিক নিয়মিতকরণে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। এসব এলাকার বাস্তুহীন দরিদ্র নারীদের একটি অংশ জরায়ু ও অন্যান্য প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণে ভুগছেন।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, এসব সব নারীরা কোমরপানিতে নেমে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ধরে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করেন। তারা সহজে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও প্রজননস্বাস্থ্য সেবা পায় না। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের গাবুরা এলাকার পানির লবণাক্ততা এবং সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা একই মাত্রার। লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নারীর স্বাস্থ্যে, তাঁদের মাসিক চক্রে গোলমাল দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শ্রমিকের কর্মক্ষমতা প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্র দেশের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এসবের প্রভাব সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে।
এধরণের মানুষেরা প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে স্থায়ী অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে চলে আসছে। এতে শহরের উপর অত্যাধিক চাপ বাড়ছে। পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। বাড়ছে নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।