আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে উত্তাল গোটা ভারত। বিলটির প্রতিবাদে বিক্ষোভ আঁচড়ে পড়েছে রাজধানী দিল্লিতেও। আন্দোলন যাতে আরও সহিংস হয়ে না উঠতে পারে, সেজন্য সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
যদিও বিলটির মূল কারিগর ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ভারতজুড়ে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর বিরুদ্ধে যত আন্দোলনই গড়ে উঠুক সরকার এ বিষয়ে পিছু হটবে না। প্রতিবেশী দেশের নিপীড়িত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য যা প্রয়োজন তার সবই করবে কেন্দ্রীয় সরকার, যা কিছু হোক না কেন, মোদি সরকার এই শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া ও ভারতীয় হিসেবে গর্বিত হয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
চলতি মাসে ভারতে পাস হয়েছে বিতর্কিত নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল। ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে এই সংশোধনের ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে চলে আসা হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। শুধু এ সুযোগ পাবেন না মুসলমানরা।
বিতর্কিত বিলটির বিরোধিতা যেখানে গোটা ভারত জুড়েই, সেখানে এখন সবচেয়ে আলোচিত একটি নাম দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা তিনটি বাসে আগুর ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়ে এবং শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। সেই মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভাইরাল ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী একজন ছাত্রকে পুলিশের বেধড়ক পিটুনি থেকে রক্ষা করছেন। তাদের মধ্যে দুইজন মেয়ের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তাদের একজন লাদিদা সাখলুন, অন্যজন আয়েশা রিনা এন। পুলিশের হাত থেকে আন্দোলনকারী এক ছাত্রকে রক্ষা করে তারা রাতারাতি তারকা বনে গেছেন। প্রশংসায় ভাসছেন এই দুই তরুণী।
কেরালার মেয়ে লাদিদা সাখলুন (ডাকনাম ফারজানা) জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারাবিকের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিনি এর আগে অর্থনীতিতে স্নাতক করেছেন। এখন অ্যারাবিকে দ্বিতীয় স্নাতক করছেন জামিয়া মিলিয়া থেকে।
লাদিদার বাবা একজন বিক্রয়কর্মী এবং মা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেষ করে একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিতা লাদিদা বরাবরই সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এবং একজন একনিষ্ঠ মুসলমান। ইসলামি অনুশাসনের ভিত্তিতে সমাজ গঠনে তরুণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করা স্টুডেন্ট’স ইসলামিক অর্গানাইজেশনের (এসআইও) একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। তার স্বামীও এই সংগঠনের একজন সদস্য।
লাদিদার অরিজিনাল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়েছে। পরে তিনি নতুন ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তবে তার ফেসবুকের প্রথম দিককার পোস্টগুলো ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা। পরে সেগুলো ডিলিট করে দেয়া হয়।
তার ১৪ ডিসেম্বরের একটি পোস্টে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। দিস ইস আওয়ার স্লোগান। দিস উইল বি আওয়ার স্লোগান।’
আয়েশা রিনা এনের জন্মও কেরালায়। তিনি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে মাস্টার্স করছেন। এর আগে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলজীবন শেষ করেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত আয়েশার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি বর্তমানে ইন্ডিয়া টুমোরো ইংলিশ নামে একটি পোর্টালে কাজ করছেন। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ছবি দিয়ে ঢাকা তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করা কেরালাভিত্তিক ‘ইয়েস ইন্ডিয়া’ নামে একটি এনজিওর হয়ে কাজ করছেন আয়েশা। তার দাবি, তিনিও ফেসবুকে কোনো কিছু পোস্ট দিতে পারছেন না। কিছুদিন আগে তিনি নতুন ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলেছেন।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের বিধান রেখে দেশটির নতুন এই নাগরিকত্ব আইন ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে টানা বিক্ষোভ করছেন ছাত্র-জনতা। বৃহস্পতিবার দেশটিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করেছে পুলিশ। গত কয়েকদিনের সংঘর্ষে অন্তত সাত বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সরকার গত ১১ ডিসেম্বর দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাসের পর এই বিক্ষোভের শুরু হয়। ২০১৪ সালে দেশটিতে ক্ষমতায় আসার পর এমন তীব্র বিক্ষোভ এবং বিরোধিতার মুখে প্রথমবারের মতো পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি এবং জৈন সম্প্রদায়ের সদস্যরা সে দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। তবে এ আইনে মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে একই ধরনের বিধান রাখা হয়নি।
সমালোচকরা বলেছেন, ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ভারতে বিভাজন তৈরি করতে এ নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বিতর্কিত এই আইনে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কিছু না বলায় ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তবে বিক্ষোভের দাবানল বেশি ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। (ইন্ডিয়া টুডে থেকে ঈষৎ অনূদিত)
ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।