ধর্ম ডেস্ক : আরাফার দিন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেভাবে অবতরণ করা তাঁর মহান শান ও মানের সঙ্গে মানানসই। তারপর তিনি আরাফার লোকদের নিয়ে নিজ ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে সহিহ মুসলিমে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের চেয়ে উত্তম এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। নিশ্চয়ই তিনি নিকটবর্তী হন। অতঃপর তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে বলেন, এরা কী চায়?’
হে ওইসব লোক, যারা নিজেদের রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, নিজেদের ফরজ আদায়ের সংকল্প করেছেন, যাতে নিজেদের লাভের দিকগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আপনারা আল্লাহর নামের জিকির করতে পারেন। সুখময় হোক আপনাদের এখানে পৌঁছা। এটা নিরাপদ সম্মানিত স্থান। এটা আল্লাহর সম্মানিত গৃহ। এখানে আছে মাকামে ইবরাহিম ও জমজম এবং হাজরে আসওয়াদ ও মুলতাজাম। এখানেই তো মাশআরে হারাম, মিনা ও আরাফা। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। এখানে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। পাপ ও গোনাহ ক্ষমা করা হয়। আল্লাহ আপনাদের ইবাদত কবুল করুন। আপনাদের ইবাদতগুলোকে পূর্ণতা দান করুন। ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এতে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭)।
আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথিরা, এ উম্মতের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের একটি দিক হলো, তিনি এদের জন্য ইবাদতের কিছু মৌসুম দান করেছেন। তেমনি একটি মৌসুম জিলহজের প্রথম দশক, যা আমরা অতিবাহিত করছি। এগুলো মহামূল্যবান দিন। আল্লাহ তায়ালা নিজ কিতাবে দিনগুলোর কসম করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা ফজর : ১-২)।
দিনগুলোতে সমাবেশ ঘটে ফজিলত ও মর্যাদার বহু বৈশিষ্ট্য। দিনগুলোতে সম্পাদিত যে কোনো ইবাদতের প্রতিদান অনেক বেশি। এসব দিনের মর্তবা সবচেয়ে বেশি। সেই তো সৌভাগ্যবান, দিনগুলোকে যে লুফে নেয়। এর সুবাসিত সময়গুলো কাজে লাগায়। সহিহ বোখারিতে ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘কোনো দিনের আমলই এ দিনগুলোতে কৃত আমলের সমান নয়। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, জিহাদও নয় কি? তিনি বললেন, জিহাদও নয়। তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া যে নিজের জানমাল নিয়ে জিহাদে যায় আর এর কোনোটা নিয়েই ফিরে না আসে।’
বোঝা গেল, নবী (সা.) দিনগুলোতে সব ধরনের নেক আমলে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমনÑ নামাজ-রোজা, দান-কোরআন, পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার, আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক, অন্যের বিপদ দূর করা, অপরের প্রয়োজন মেটানোসহ সব ধরনের পুণ্যকাজ। এ দশ দিনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হজ করা, যা ইসলামের অন্যতম প্রধান ফরজ। পাপ ও অপরাধ মার্জনার বৃহত্তম দ্বার। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ওমরা থেকে অপর ওমরা মাঝের গোনাহগুলোর জন্য কাফফারা আর মাবরুর হজের একমাত্র পুরস্কার জান্নাত।’
একটি হজ তখনই শুধু মাকবুল ও মাবরুর হয়, যখন তা সম্পাদন করা হয় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অনুকরণে। এতএব হে আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথিরা, নিজেদের রবের আদেশের অনুবর্তী হোন, নিজেদের হজের পবিত্র স্থানগুলোতে অবস্থান করুন এবং নিজেদের হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করুন। সর্বোপরি আপনাদের রাসুল (সা.) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করুন।
মোমিন ভাইয়েরা, এই মোবারক দিনগুলোতে রয়েছে আরাফা দিবস। এটি আল্লাহ তায়ালা বনি আদমদের যে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন তা পূরণের দিন। মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ না’মানে অর্থাৎ আরাফার ময়দানে আদম সন্তান থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। আদমের সব সন্তানকে তার পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন এবং তাদেরকে নিজের সামনে (পিঁপড়ার আকারে) ছড়িয়ে দিলেন। অতঃপর তাদের জিজ্ঞেস করলেন [আমি কি তোমাদের রব নই? সবাই বলেছিল, অবশ্যই, আমরা সবাই সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটি এ জন্য যে, তোমরা যেন কেয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে গাফেল ছিলাম]।’
আরাফার দিনই আল্লাহ তায়ালা বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। তারা এদিন আরাফায় অবস্থানকারী হোক বা অন্য দেশে থাকায় আরাফাবাসী না হোক। অতএব আপন রবের প্রতি বিগলিত হোন। তাঁর রহমত গ্রহণ করুন। তাঁর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভে কামিয়াব হোন।
আরাফার দিন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেভাবে অবতরণ করা তাঁর মহান শান ও মানের সঙ্গে মানানসই। তারপর তিনি আরাফার লোকদের নিয়ে নিজ ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে সহিহ মুসলিমে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের চেয়ে উত্তম এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। নিশ্চয়ই তিনি নিকটবর্তী হন। অতঃপর তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে বলেন, এরা কী চায়? এরা কী চায়?’
যে কোনো স্থানে অবস্থানকারী হে মোমিন ভাই, হজে আসা এই মৌসুমকে লুফে নেওয়া লোকেরা হজের সবচেয়ে বড় রুকন আরাফায় অবস্থান করে সফল হয়ে যাচ্ছেন, তখন অন্য সবার জন্যও অবারিত এ মহান দিনের রোজা পালনের সুযোগ। কেননা এই একটি রোজা দুই বছরের গোনাহের জন্য কাফফারা। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে সহিহ মুসলিমে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে তা বিগত এক বছর এবং আগামী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’
এই মোবারক দিনগুলোর ফজিলতের আরেকটি দিক হলো, এতে রয়েছে ইয়াওমুন নাহর বা কোরবানির দিন। এটি আল্লাহর কাছে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ও প্রিয়তম দিন। এর মর্যাদা সর্বাধিক। এতে রয়েছে কোরবানির মতো আমল, যা প্রাচীনতম ইবাদত। আমাদের পূর্ববর্তী সবাই যার মাধ্যমে আল্লাহর দাসত্ব বাস্তবায়ন করেছে। ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা হজ : ৩৪)। অর্থাৎ পশু জবাই ও রক্ত প্রবাহিত করার বিধান দিয়েছি। ‘যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (প্রাগুক্ত)।
আল্লাহর বান্দারা, কোরবানি একটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। সামর্থ্যবান কারও জন্য এটি ত্যাগ করা সমীচীন নয়। আর যিনি কোরবানি করতে চান তার কর্তব্য, জিলহজের প্রথম দশক শুরু হওয়ার পর কোরবানি করার আগ পর্যন্ত চুল, নখ ও পশম না তোলা থেকে বিরত থাকা। উম্মে সালামা (রা.) থেকে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির ইচ্ছা করে, সে কোরবানি না করা পর্যন্ত যেন চুল বা নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্য, নামাজে দ-ায়মানদের জন্য এবং রকু সেজদাকারীদের জন্য। এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তার দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।’ (সূরা হজ : ২৬-২৯)।
আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথিরা, যে কেউ এসব দিনের নেক আমল সংক্রান্ত কোরআন ও সুন্নাহর বাণীগুলোতে লক্ষ্য করবে, দেখতে পাবে সবই আসলে উদ্বুদ্ধ করেছে বেশি বেশি এক আল্লাহর জিকির করতে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত আল্লাহর জন্য দাসত্ব, তাঁর প্রতি বিনয় ও মুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করা। এই পবিত্র দিনগুলোকে কোনো গোঁড়ামি বা অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক সেøাগান বা বর্ণবাদী দাবি দিয়ে কলুষিত না করা। ‘অতএব হজে (ইহরাম অবস্থায়) জায়েজ নয় স্ত্রীর সঙ্গে নিরাবরণ হওয়া, অশোভন কোনো কাজ করা বা ঝগড়া-বিবাদ করা।’ (সূরা বাকারা : ১৯৭)। মুস্তাদরাক হাকেমে সহিহ সনদে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় পাথর নিক্ষেপ, তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ প্রবর্তন করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহর জিকির বাস্তবায়নের জন্য।’
নবী (সা.) এ দিনগুলো বিশিষ্ট করেছেন তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) দ্বারা। পবিত্র কোরআনে রয়েছেÑ ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময়।’ (সূরা হজ : ২৮)। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এ দশ দিন মানুষের মধ্যে তাকবিরের সুন্নত জিন্দা করতেন। সহিহ বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা (রা.) এ দশ দিন বাজারে বের হতেন। তাঁরা তাকবির দিতেন আর তাদের সঙ্গে লোকেরাও তাকবির দিত।’ ইবনে ওমর (রা.) মিনায় নিজ তাঁবুতে বসে তাকবির দিতেন। সেটা মসজিদের লোকেরা সবাই শুনত। তারাও তাকবির দিতে শুরু করত। তাদের তাকবির শুনে বাজারের সবাইও তাকবির দেওয়া শুরু করত। এভাবে পুরো মিনা প্রান্তর তাকবিরে প্রকম্পিত হয়ে উঠত। সুতরাং এ পবিত্র কয়দিন সবার জন্য মোস্তাহাব ও কাম্য আমল হলো, ঘরে-বাইরে ও মসজিদ-বাজারে তাকবিরের ধ্বনি উচ্চকিত করা। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
(শায়খ ড. মাহের বিন হামাদ আল-মুআইকিলি)
১ জিলহজ ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার ভাষান্তর
আলী হাসান তৈয়ব
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।