জুমবাংলা ডেস্ক : পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে এসব ব্যাংকে ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে সম্পদের গুণগত মান যাচাই (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ-একিউআর) করা হয়েছে। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করে একীভূত করার প্রাথমিক পর্যায়ের রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে। এই নিয়ে ব্যাংকগুলোর গ্রাহক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। খবরের কাগজের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
ব্যাংক পাঁচটি হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এই পাঁচ ব্যাংকের দায়িত্ব দেয় নতুন পর্ষদের। এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই পাঁচ ব্যাংকের সম্পদের মান নিরীক্ষা শেষ হয়েছে। এসব ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে তা জানানোর সুযোগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কেউ নিজেকে সবল প্রমাণ করতে পারলে সেই ব্যাংক তালিকা থেকে বাদ পড়বে। না হলে ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়া শুরু হবে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সমস্যার মূলে না গিয়ে পাঁচটি বা ১০টি ব্যাংক একীভূত করা হলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলেও মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে। এই প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা সমাধান করা যাবে না। বরং আরও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ফরেনসিক অডিট সঠিকভাবে হয়েছে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া চাপিয়ে দিয়ে একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। বরং যে ব্যাংকগুলো খারাপ হয়েছে, সেখানে সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ না করে একীভূত করলে ভালো ব্যাংকগুলোর হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে তাতে বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন না। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ নানা অনিশ্চয়তা থাকায় এই প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন, ‘পাঁচটি বা ১০টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা হলেই যে একটা শক্তিশালী ব্যাংক হয়ে যাবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। ব্যাংকগুলোর মূল যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো দূর করার উদ্যোগ না নেওয়া হলে পাঁচটি, ১০টি বা ৫০টি ব্যাংক একত্রিত করলেও কোনো লাভ হবে না। এর জন্য মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। মূল সমস্যার মধ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ দূরীকরণ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন উন্নত দেশে কোনো ব্যাংক সমস্যায় পড়লে সেটা অবসায়ন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই চর্চা নেই। একসময়ের দুর্দশাগ্রস্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে পরিচালিত হচ্ছে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক হিসেবেই পরিচালিত হয়ে আসছে, বর্তমানে যার প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণই খেলাপি।’
৫ ব্যাংক একীভূতকরণের রোডম্যাপ
সম্প্রতি পাঁচটি ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একীভূতকরণের প্রাথমিক পর্যায়ের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। বৈঠকে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংকে যে ফরেনসিক অডিট হয়েছে, চলতি মাসেই সেই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। অডিট রিপোর্ট প্রকাশের পর এসব ব্যাংকের সঙ্গে শুনানি ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে চাইবে কোন কোন ব্যাংক নিজেরা নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে। অর্থাৎ কোন কোন ব্যাংক নিজস্ব কৌশলে টিকে থাকতে পারে তা যাচাই করা হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর শ্রেণিবিন্যাস, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা মূল্যায়ন করা হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দু-একটি ব্যাংককে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এই প্রক্রিয়া শুরু হবে আগামী জুলাইয়ে আর শেষ হবে অক্টোবরের মধ্যে। একীভূতকরণের আওতায় ব্যাংকগুলোর যেসব ঋণ খারাপ হয়ে পড়েছে, তা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (এএমসি) কাছে হস্তান্তর করা হবে। এমনভাবে সম্পদ হস্তান্তর করা হবে, যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এতে বিদেশি বাণিজ্যে লেনদেনে খরচ কম হবে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ব্যাংক টাকা নিতে পারবে। এতে মূলধন জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার ও বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা। এ জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় সেই ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকের শাখাগুলো একীভূত করা হবে। এ জন্য জনবলও কমানো হবে। ব্যাংক পূর্ণাঙ্গভাবে যাত্রা শুরুর পর বেসরকারি খাতে শেয়ার ছাড়া হবে, এরপর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হতে পারবেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অন্তত তিন বছর সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক একীভূতকরণ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, বর্তমানে যে অবস্থায় দেশের ব্যাংকিং খাত দাঁড়িয়েছে, এখান থেকে বের হতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। বর্তমান গভর্নরের সেই সদিচ্ছা আছে। তিনি সেই লক্ষ্যেই কাজ করছেন। এর অংশ হিসেবেই ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। তৃতীয়ত, ব্যবস্থাপনাগত বিষয়। অর্থাৎ যারা এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করবেন তাদের সদিচ্ছা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে এবং ব্যাংকগুলোকে নতুন করে মূলধন দিয়ে শক্তিশালী করার পাশাপাশি খারাপ ঋণগুলোর দায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যদি ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা আনা যায়, তখন হয়তো ব্যাংকগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
একীভূত করার প্রতিবন্ধকতা
প্রতিটি ব্যাংক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় এই ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তো হবেই। একই বিল্ডিংয়ে একাধিক ব্যাংকের শাখা রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে সবগুলো ব্যাংকই সরকারি মালিকানায় চলে যাবে এবং ঘোষণা করা হবে এগুলো সরকারি ব্যাংক। সরকার থেকেই ব্যাংকগুলো পরিচালনার সিদ্ধান্ত আসবে। আপাতত এই ব্যাংকগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে চলবে ট্রায়াল অ্যান্ড অর্ডারের মাধ্যমে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত আসবে এক জায়গা থেকে বা কেন্দ্রীয় কমান্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হবে।
প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা এমডি, চেয়ারম্যানসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন- একীভূত করা হলে এ ক্ষেত্রে কী করা হবে জানতে চাইলে মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হবে না, বেতনও কমবে না। তবে ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে। একটি ব্যাংক হলে একটি বোর্ড হতে পারে। সেখানে একজন প্রশাসক থাকতে পারে। প্রতিটি ব্যাংক আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে যাবে।
নির্বাচনের আগেই ৫ ব্যাংক এক হবে
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বেসরকারি খাতের পাঁচ ইসলামী ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নির্বাচনের সঙ্গে এই একীভূতকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা আশা করি, আগামী সরকারও এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে। তবে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হবে। এ সময় তিনি ব্যাংক কর্মীদের আশ্বস্ত করে বলেন, এই একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মীকে চাকরি হারাতে হবে না।
জানা গেছে, সারা দেশে ওই পাঁচ ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৭৭৯টি। এ ছাড়া এসব ব্যাংকের ৬৯৮ উপশাখা, ৫০০ এজেন্ট ও ১ হাজার এটিএম বুথ রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে জনবল রয়েছে ১৫ হাজারের বেশি। এসব ব্যাংকের গ্রাহকের হিসাবের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৯২ লাখ। আমানত ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, তবে ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক দুই অডিট ফার্মের একিউআর প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।