জুমবাংলা ডেস্ক : সাদা হাতি! শব্দদ্বয় বেশ পরিচিত। এটি বলতে সাধারণত উপযোগিতার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণ আরও ব্যয়বহুল এমন কিছুকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থেই চালুর এক বছরের মাথায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল সাদা হাতিতেই রূপান্তরিত হয়েছে।
বিপুল সংখ্যক যানবাহন চলাচল করবে, আর তার টোল দিয়েই নির্মাণব্যয় তো উঠে আসব, পরিশোধ করা যাবে বিদেশি ঋণও–টানেল নির্মাণের আগে আওয়ামী লীগ সরকার এমন প্রত্যাশার বেলুন ফোলালেও ক্রমেই যেন সেটি চুপসে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
এক বছর আগে, ২৮ অক্টোবর চালু করা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নদীর তলদেশে দিয়ে নির্মিত এই টানেলটি। সে হিসেবে টানেল চালুর এক বছর হলো সোমবার (২৮ অক্টোবর)। এই এক বছরে প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলেনি। ফলে টোল আদায় হয়েছে একেবারে কম। আয়ের চেয়ে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয়েছে ৭২ গুণ বেশি অর্থ। এই কারণে এটিকে অনেকেই বলছেন লোকসানি প্রকল্প। যদিও টানেল কর্তৃপক্ষ আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে চান।
টানেল কর্তৃপক্ষের হিসেবে, প্রথম বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চালাচল করার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন গাড়ি চলছে তার প্রায় ছয়গুণ কম, গড়ে ৩ হাজার ৯১০টি। সেজন্য প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৪ টাকা টোল আদায় হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশও টানেল থেকে আয় হচ্ছে না, লোকসান হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার ৮৩৯ টাকা।
টানেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। এর মধ্যে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস (হালকা যানবাহন) চলাচল করেছে ৭৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বাস ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ দশমিক ৪ শতাংশ ও ট্রেইলর দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২২ অক্টোবর পর্যন্ত টানেল দিয়ে গড়ে চলেছে ৩ হাজার ৯১০টি গাড়ি। সবমিলিয়ে এক বছরে টোল আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬১ হাজার ২১০ টাকা। কিন্তু এই টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণে দৈনিক ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩ টাকা। সে হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণে এক বছরে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ৭৬ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৫ টাকা। দেখা যাচ্ছে এই এক বছরে লোকসান গুণতে হয়েছে ৯৮ কোটি ৯০ লাখ ১ হাজার ২৩৫ টাকা।
মূলত সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় লোকসানি প্রকল্পে রূপ নিয়েছে এই স্বপ্নের টানেল। অবশ্য কক্সবাজার ও মাতারবাড়িকে টানেলের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করার বিষয়ে কাজ চলছে। এটা সম্ভব হলে যানবাহন চলাচল এবং আয় বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
টানেলের সুফল পেতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে জানিয়ে টানেলের উপপ্রকল্প পরিচালক (কারিগরি) আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, টানেল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, এখানে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটাকে লোকসানি প্রকল্প বলা যাবে না। এ প্রকল্পের সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ, চায়না অর্থনৈতিক জোন, আনোয়ারা-বাঁশখালী-কক্সবাজার সড়ক এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম আনোয়ারা কর্ণফুলী প্রান্তে স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব বাস্তবায়িত হলে এই টানেল দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
গত ২৬ অক্টোবর সকালে টানেলের সার্বিক বিষয় দেখতে পরিদর্শনে এসেছিলেন সেতু বিভাগের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। তিনি টানেল রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে চায়না ইকোনমিক জোন ও বিকল্প সড়ক চালু না হওয়ায় গাড়ি কম চলছে বলে মনে করেন তারা।
তবে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে বিশাল ফারাক দেখতে পেয়ে হতাশ স্থানীয়রা। টানেলকে ঘিরে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-মডেলের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে আনোয়ারা প্রান্তে টানেলকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা ৭টি ব্যাংকের শাখা, বিভিন্ন মার্কেট ও শতাধিক দোকানপাট এখন লোকসানের মুখে এবং অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। টানেলের কারণে শুরুতে জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এখন ভাটা পড়েছে বেচাবিক্রিতেও।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘টানেল নির্মাণ কতটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত’ শিরোনামের এক গবেষণাপত্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক টানেল প্রকল্পটিকে অদূরদর্শী পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ওই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে শাহ আমানত সেতু। এ সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের টোলহার যানবাহন-ভেদে আড়াই থেকে ৬ গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্য টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম সফরে এসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজমও কথা বলেছেন টানেল নিয়ে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী টানেল কার নির্দেশে, কাদের জন্য করা হয়েছে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় ‘চোখ ধাঁধানো’ এই প্রকল্পকে গতিশীল করতে অন্তবর্তীকালীন সরকার কি উদ্যোগ নেয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।