যখন হার্টের স্পন্দন তালে তালে মিশে যায় র্যাকেটের টং শব্দের সাথে, যখন পায়ের পাতায় লাগা মাটির গন্ধ আর ঘামে ভেজা জার্সি মনে করিয়ে দেয় জীবনের প্রাণশক্তি—সেই মুহূর্তগুলোই শুধু খেলার আনন্দ দেয় না, গড়ে তোলে এক অদৃশ্য স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ। ঢাকার উত্তরা কিংবা চট্টগ্রামের পাহাড়ি পথে ভোরে টেনিস কোর্টে জড়ো হওয়া সেই সব মানুষ, যাদের বয়স ১২ থেকে ৭০—তারা শুধু বল ঠুকছে না, ঠুকছেন অসুখ-বিসুখের ভয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ রিপোর্ট বলছে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিটের মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ৩০%। আর টেনিস? তা তো শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা আর সামাজিক বন্ধনের একত্রিত মন্ত্র। টেনিস খেলার উপকারিতা কেবল পেশির গঠনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ায়, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল কমায়, এমনকি ডায়াবেটিসের মতো নীরব ঘাতককেও রুখে দাঁড়াতে শেখায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ফিটনেস কোচ মোহাম্মদ সাজ্জাদের কথায়, “আমরা ক্রিকেটারদের ফিটনেস রুটিনে টেনিস রাখি—এটি রিফ্লেক্স, স্ট্যামিনা আর কৌশলগত চিন্তার সমন্বয় ঘটায়।” এই লেখায় আমরা জানব, কীভাবে একটি র্যাকেট আর হলুদ বল হয়ে উঠতে পারে আপনার দীর্ঘ জীবনের গ্যারান্টি।
টেনিস খেলার উপকারিতা: কেন এটি স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ?
টেনিস শুধু একটি খেলা নয়, এটি এক প্রাণবন্ত ওষুধ। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন ১ ঘণ্টা টেনিস খেলে হার্টের কার্যক্ষমতা ১৫% বৃদ্ধি পায়। কেন? কারণ টেনিস হলো ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং—দ্রুত দৌড়ানো, হঠাৎ থামা, পাশ কাটানো। এই অনিয়মিত গতিবিধি হার্টকে চ্যালেঞ্জ জানায়, ফলে কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম শক্তিশালী হয়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডাটা অনুযায়ী, যারা নিয়মিত টেনিস খেলে তাদের হাইপারটেনশনের ঝুঁকি ৪০% কমে। রাজশাহীর মেডিকেল কলেজের ফিজিওথেরাপিস্ট ড. ফারহানা ইয়াসমিনের পর্যবেক্ষণ: “টেনিস খেলার সময় হাত-পা-চোখের সমন্বয় মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশন বাড়ায়, যা স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করে।”
ওজন ব্যবস্থাপনায় টেনিসের ভূমিকা অপরিসীম। ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষ এক ঘণ্টা সিঙ্গেলস টেনিস খেলে পোড়ান প্রায় ৫০০ ক্যালরি! খুলনার জনপ্রিয় ফিটনেস ট্রেনার শিমুল রায়ের মতে, “টেনিস ফ্যাট বার্ন করার পাশাপাশি মেটাবলিক রেট বাড়ায়, ফলে বিশ্রামের সময়ও ক্যালরি পোড়ে।” বাংলাদেশের শহুরে জীবনে স্থূলতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ রিপোর্ট অনুসারে, ঢাকার ৩৪% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ওভারওয়েট। টেনিস এই সংকট মোকাবিলায় একটি প্রাকৃতিক সমাধান।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে টেনিসের প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। টেনিস খেলার সময় মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন ও সেরোটোনিন নিঃসৃত হয়, যা উদ্বেগ ও হতাশা দূর করে। অস্ট্রেলিয়ান স্টাডি বলছে, টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার ৩৫% কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. তাহসিনা ইসলামের ভাষ্য: “টেনিসে প্রতিপক্ষের গতিবিধি অনুমান করতে গিয়ে ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়।”
টেনিস খেলার শারীরিক ও মানসিক উপকারিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
হাড় ও পেশির গঠনে টেনিসের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দৌড়ানো, লাফানো ও র্যাকেট সুইং করার সময় পায়ের পেশি, কাঁধ, বাহু ও কোর শক্তিশালী হয়। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য এটি অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে কার্যকর। আইপিটি (International Physical Therapy) জার্নালের গবেষণা নিশ্চিত করে: সপ্তাহে ৩ বার টেনিস খেলে হাড়ের ঘনত্ব ৫% বাড়ে। বাংলাদেশে ৬০ ঊর্ধ্ব ২৫% মানুষ হাড়ক্ষয়ে ভোগেন—চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন ডা. আরিফুল হকের পরামর্শ: “৬৫+ বয়সীদের জন্য লো-ইমপ্যাক্ট টেনিস (সফট বল দিয়ে) আদর্শ।”
চোখ ও হাতের সমন্বয় উন্নত করে টেনিস। প্রতি সেকেন্ডে ২০০ কিমি গতির বলকে ট্র্যাক করতে গিয়ে চোখের রেটিনা ও মস্তিষ্কের দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতা বাড়ে। টেনিস কোচ ও সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় রফিকুল ইসলামের ব্যাখ্যা: “একটি ফোরহ্যান্ড শটের জন্য মস্তিষ্ক ০.৩ সেকেন্ডে ৫টি সিদ্ধান্ত নেয়—বলের গতি, দিক, আপনার পজিশন, র্যাকেট অ্যাঙ্গেল ও শক্তি।” এই কগনিটিভ ট্রেনিং আলঝাইমার প্রতিরোধেও সহায়ক।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে টেনিসের অবদান লক্ষণীয়। ব্যায়ামের সময় পেশি গ্লুকোজ শোষণ করে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, টেনিস ইনসুলিন সেনসিটিভিটি ৪০% বাড়ায়। বাংলাদেশে ৮০ লাখ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য এটি প্রাকৃতিক থেরাপি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. শাহজাদা সেলিমের পরামর্শ: “টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীরা সপ্তাহে ১৫০ মিনিট টেনিস খেলে HbA1c লেভেল ১% কমাতে পারেন।”
বয়সভিত্তিক টেনিস: শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবার জন্য উপকারিতা
শিশু-কিশোরদের বিকাশে টেনিসের ভূমিকা অসাধারণ। ৫-১৭ বছর বয়সী খেলোয়াড়দের শারীরিক ভারসাম্য, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ঢাকার গুলশান ক্লাবের জুনিয়র টেনিস একাডেমির প্রধান কোচ নাসিমুল হাসানের অভিজ্ঞতা: “যে শিশুরা টেনিস খেলে, তাদের স্কুল পারফরম্যান্স ২০% ভালো হয়—এটি মনোযোগ ও শৃঙ্খলা শেখায়।” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BISP) স্কুল কারিকুলামে টেনিস যোগ করেছে।
মধ্যবয়সীদের জন্য টেনিস স্ট্রেস-বাস্টার। কর্পোরেট চাপ, পারিবারিক টেনশনের মাঝে কোর্টে ১ ঘণ্টা মানসিক অবসাদ দূর করে। ২০২৪ সালে সিলেটে করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, টেনিস খেলোয়াড় অফিসগোয়িন্দের কাজের উৎপাদনশীলতা ৩০% বেশি। বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি মি. সাজিদ আলীর মন্তব্য: “আমরা ঢাকার বসুন্ধরায় অফিস টেনিস লিগ চালু করেছি—সপ্তাহে ৫০০+ পেশাজীবী অংশ নেন।”
বৃদ্ধদের জন্য টেনিস সামাজিকতা ও শারীরিক সক্রিয়তা বজায় রাখে। রাজধানীর ধানমন্ডি ক্লাবে ৭০ বছর বয়সী টেনিস গ্রুপ ‘গোল্ডেন সেটার্স’ প্রতিদিন সকালে খেলেন। সদস্য ড. আনিসুর রহমান (৭৬) বলেন: “টেনিস আমার আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমিয়েছে, নতুন বন্ধু দিয়েছে।”
বাংলাদেশে টেনিস খেলার সুযোগ ও স্থান: শুরু করার গাইড
সুবিধামতো স্থান খুঁজুন:
- ঢাকায়: গুলশান ক্লাব, রমনা টেনিস কমপ্লেক্স, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস
- চট্টগ্রামে: এমএ আজিজ স্টেডিয়াম, পাহাড়তলী টেনিস কোর্ট
- বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন প্রতি মাসে আয়োজন করে বিনামূল্যে ট্রায়াল সেশনের—তথ্য পাবেন তাদের ওয়েবসাইটে
খরচ:
- ক্লাব মেম্বারশিপ: ৩,০০০-১০,০০০ টাকা/মাস
- কোচিং: ঘণ্টাপ্রতি ৫০০-১,৫০০ টাকা
- সাশ্রয়ী বিকল্প: পাবলিক পার্কে কমিউনিটি গ্রুপ (ঢাকার শেরেবাংলা নগর পার্কে প্রতি শনি-রবি সকাল ৭-৯টা)
শুরু করার টিপস:
১. সঠিক গিয়ার: র্যাকেট ও জুতা বিশেষায়িত দোকান থেকে কিনুন (ঢাকার ফকিরাপুল, স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড)।
২. বেসিক কোর্স: প্রাথমিক কোর্স নিন—ভুল টেকনিক থেকে ইনজুরি এড়াতে।
৩. গ্রুপ জয়েন: ফেসবুক গ্রুপ ‘Bangladesh Tennis Community’তে যুক্ত হন।
টেনিসে আঘাত প্রতিরোধ: সচেতনতা ও প্রস্তুতি
সাধারণ আঘাত ও প্রতিকার:
- টেনিস এলবো: বাহুর ব্যথা—প্রতিরোধে স্ট্রেচিং ও সঠিক র্যাকেট গ্রিপ।
- হাঁটুর সমস্যা: জাম্পিং বা দ্রুত দিক পরিবর্তনের সময়—প্রতিরোধে নী-সাপোর্ট ব্যবহার।
- পেশিতে টান: ওয়ার্ম-আপ ছাড়া খেললে—প্রতিরোধে ১৫ মিনিট স্ট্রেচিং।
প্রতিরোধ কৌশল:
- ওয়ার্ম-আপ: ১০ মিনিট জগিং + ১০ মিনিট ডায়নামিক স্ট্রেচ।
- হাইড্রেশন: প্রতি ২০ মিনিটে ২০০ মিলি পানি পান।
- কোর্ট জুতো: সাধারণ জুতা নয়—সাইড মুভমেন্টের জন্য ডিজাইনকৃত জুতা পরুন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (NITOR)-এর পরামর্শ: “আঘাতের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে RICE (Rest, Ice, Compression, Elevation) পদ্ধতি অনুসরণ করুন।”
বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস: রিয়াল মাদ্রিদের অমর কাহিনী
জেনে রাখুন-
টেনিস খেলার উপকারিতা কি শিশুদের জন্য নিরাপদ?
হ্যাঁ, ৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত। বিশেষায়িত জুনিয়র র্যাকেট ও সফট বল ব্যবহারে ঝুঁকি কম। এটি শিশুর গতিশীলতা, সামাজিক দক্ষতা ও একাডেমিক ফোকাস বাড়ায়। বাংলাদেশে স্কুল লেভেলে টেনিস প্রোগ্রাম চালু হয়েছে।
টেনিস খেললে কি বাতের ব্যথা বাড়ে?
বরং কমে! নিয়মিত কম-তীব্রতায় খেললে জয়েন্টের নমনীয়তা বাড়ে। তবে, তীব্র ব্যথা থাকলে ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন। সঠিক টেকনিক ও ওয়ার্ম-আপ বাতের ব্যথা প্রতিরোধ করে।
কতদিন পর টেনিসের স্বাস্থ্য উপকারিতা দেখা যায়?
সপ্তাহে ৩ দিন, ৪৫ মিনিট করে খেললে ৪-৬ সপ্তাহে স্ট্যামিনা, রক্তচাপ ও মেজাজের উন্নতি টের পাবেন। দীর্ঘমেয়াদি উপকারিতার জন্য নিয়মিততা জরুরি।
টেনিস খেলার জন্য সর্বোচ্চ বয়স কত?
কোনো সর্বোচ্চ বয়স নেই! বিশ্বে ৯০+ বয়সী টেনিস খেলোয়াড় রয়েছেন। বাংলাদেশে ধানমন্ডি ক্লাবে ৭৫+ বয়সীদের নিয়মিত গ্রুপ খেলে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে শুরু করুন।
কোথায় সাশ্রয়ী মূল্যে টেনিস শিখতে পারি?
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BISP) ও জেলা ক্রীড়া অফিসে বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া, স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারেও ক্লাস পাওয়া যায়।
টেনিস খেলার উপকারিতা: স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ শুধু একটি বাক্য নয়, এটি জীবন বদলে দেওয়ার হাতিয়ার। আপনি যখন মাঠে দৌড়ে বল মারা, তখন আপনার হৃদপিণ্ড শক্তিশালী হচ্ছে, হাড়ের ঘনত্ব বাড়ছে, মস্তিষ্কের কোষ সতেজ হচ্ছে। ঢাকার রমনা পার্কের সেই ৬৫ বছরের দিদি, যিনি প্রতিদিন সকালে টেনিস খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, কিংবা খুলনার সেই কিশোর যে টেনিসের মাধ্যমে ADHD কে জয় করেছে—তারা প্রমাণ, এই খেলা বয়স বা শারীরিক সীমাকে অতিক্রম করে। একটি র্যাকেট, দুটি শুভ্র লাইন—এটাই হতে পারে আপনার অকৃত্রিম ডাক্তার, বিশ্বস্ত থেরাপিস্ট ও আনন্দের বন্ধু। এখনই উঠে পড়ুন। নিকটস্থ কোর্টে যান। প্রথম শটটা খেলুন। আপনার শরীর ও মন বলবে ধন্যবাদ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।