বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়া শহরের বসতবাড়ির মালিকদের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা অন্তত ৯০ লাখ টাকা পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলেমিশে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুয়া রসিদ বই ছাপিয়ে এবং রসিদ বইয়ের কার্বন কপি জালিয়াতি করে পৌরসভা কার্যালয়ে বসেই বছরের পর বছর ধরে এ অপকর্ম করা হলেও তা কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরপরই পৌর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
দুদকের তৎপরতার মুখে ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন এক সচিবকে বদলি, কর বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং চুক্তিভিত্তিক অপর ছয় কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতির পাশাপাশি পৌর কর বিভাগের তিন কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধানও শুরু করেছে। এসব তৎপরতার মুখে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে আত্মসাৎ করা ৬৭ লাখ টাকা ফেরতও দেওয়া হয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৪ সাল থেকে ওই অপকর্ম চলেছে। আর পৌরসভার কর্মকর্তারা বলছেন- ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে পরবর্তী দুই বছর ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে এ অপকর্মে ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা মিলেছে। তবে পৌরসভার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে নয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন সচিব ইমরোজ মুজিবকে জেলার শেরপুর পৌরসভায় বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভার বাজার আদায়কারী একেএম আকিল আহম্মেদ মোমিন ও সহকারী কর নির্ধারক রায়হানুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর আলমগীর রহমান, মশিউর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন, বেলাল হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন ও মাসুদ সরকার কনকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। সংস্থাটির কর বিভাগের আরও ছয় কর্মকর্তা শফিউল আলম, জামিল মজুমদার, জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর রহমান, হেফজুল বারী ও সারওয়ার জাহানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি দুদক খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অভিযুক্তরা দু’ভাবে ট্যাক্সের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রথমত, তারা রসিদ বইয়ের গ্রাহকের কপিতে জমা করা টাকার পরিমাণ সঠিক লিখলেও নিচের কার্বন কপিতে কম লিখতেন। দ্বিতীয়ত, ভুয়া জমা বই ছাপিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা পুরো টাকাই নিজেদের পকেটে ভরতেন। এভাবে আত্মসাৎ করা টাকা অভিযুক্তরা নির্ধারিত পার্সেন্টেজে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেন।
এদিকে, অনুসন্ধানকালে তাদের অর্থ ভাগাভাগির একটি নথি সমকালের হাতে এসেছে। কম্পিউারে তৈরি ওই শিটে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা টাকার মধ্যে পৌরসভার সচিব থেকে কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কে কত পার্সেন্ট পকেটে তুলবেন তার উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে সবচেয়ে বেশি ৩৫ পার্সেন্ট সচিবকে দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই নথিতে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর (১৩৭৭০ ও ৩৪১২৬ নং শিটে) ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা ৪৭ হাজার ৮৯৬ টাকার মধ্যে পৌরসভায় জমা করা হয়েছে ৫৬ দশমিক ২১ শতাংশ বা ২৬ হাজার ৯২৬ টাকা। বাদবাকি ২০ হাজার ৯৫১ টাকা নিজেরা আত্মসাৎ করেছেন।
বগুড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র শামছুদ্দিন শেখ হেলাল জানান, কর শাখায় যে দুর্নীতি হচ্ছে সেটা প্রথমদিকে তারা বুঝতে পারেননি। একদিন এক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বাসায় গিয়ে তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চাইলে তার সন্দেহ হয়।
তিনি বলেন, ‘কর বিভাগের একজন কর্মচারী কেন আমাকে এতগুলো টাকা দিতে এসেছে। সে এ টাকা পেল কোথায়। ওই চিন্তাভাবনা থেকেই আমি অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, তারা দীর্ঘদিন ধরে জনগণের ট্যাপের টাকা আত্মসাৎ করে আসছে।’
শামসুদ্দিন শেখ হেলাল বলেন, ‘ওই ঘটনার আর যাতে কোনো দুর্নীতি না হয় সেজন্য আমরা পৌরসভায় ব্যাংকের বুথ স্থাপন করে তাতে ট্যাপের টাকা জমার ব্যবস্থা করেছি। এতে আগের তুলনায় ট্যাপ আদায়ের হারও কয়েকগুণ বেড়েছে।’
দুদক বগুড়া জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক তদন্তে ৯০ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। তিনি বলেন, আমরা মামলার জন্য সবকিছু চূড়ান্ত করছি।
অপর সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকী বলেন, ‘পৌর কর বিভাগের তিন কর্মকর্তার সম্পদের অনুসদ্ধান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাদের তলবও করা হয়েছিল।
বগুড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট একেএম মাহবুবর রহমান জানান, ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ওই ঘটনা বিলম্বে জানতে পারলেও প্রাথমিক তদন্তে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের দপ্তর এবং দুদকও পৃথকভাবে তদন্ত করছে। জড়িদের কাউকে ছাড়া হবে না।
যোগাযোগ করা হলে বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন সচিব ইমরোজ মুজিব ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমি দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম বলেই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পৌরসভার বাজার কর আদায়কারী একেএম আকিল আহম্মেদ মোমিনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি টেলিফোনে কোনো কথা বলব না, সাক্ষাতে কথা বলব।’ সূত্র: সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।