জুমবাংলা ডেস্ক: ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিমেল সাহা বলছেন বাংলাদেশে যত মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন তার বেশিরভাগের জন্যই দায়ী এই ট্রান্সফ্যাট। খবর বিবিসি বাংলার।
সার্বিকভাবে চিকিৎসক ও গবেষকরা চর্বি ও ট্রান্সফ্যাটকে হৃদরোগের জন্য দায়ী করেন। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে যত মানুষ মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় এই হৃদরোগে, যার সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
গবেষকরা বলছেন হৃদরোগ এভাবে ছড়িয়ে পড়ার বড় কারণই হলো ট্রান্সফ্যাট।
মিস্টার সাহা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভাজা-পোড়া, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস বা এ ধরণের অসংখ্য অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা আছে। এটাই ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগের কারণ”।
কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন তাদের এক গবেষণার অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ১০টি বিস্কুট পরীক্ষা করে এগুলো মধ্যে ৫ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
ঢাকার মীরবাগ এলাকার একজন গৃহিনী মারিয়া সুলতানা বলছেন, কোন খাবারগুলোতে এ ধরণের ট্রান্সফ্যাটের ঝুঁকি বেশি তেমনটি তার জানা নেই।
“আমি সুপার শপ থেকে অনেক কিছু কিনি নিজের, বাচ্চাদের বা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য। কোথাও তো এসব কিছু লেখা দেখিনা। ফলে জানিওনা যে কোন খাবারগুলো আমার এড়িয়ে চলা উচিত”।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাজনীন সাফিয়া বলছেন ক্যাম্পাস খোলা থাকলে যেসব খাবার বিক্রি হয় সেগুলোর অনেকগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এটি তার জানা থাকলেও ট্রান্সফ্যাট বিষয়টি এভাবে তারা জানা ছিলোনা।
“আমরা তো আড্ডায় গল্পে চানাচুর, মুড়ি বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের মতো ফাস্টফুডই বেশি খাই। কিন্তু কেউ তো বলেনি যে এগুলোর মধ্যে এমন একটি বিপজ্জনক উপাদান তৈরি হয় শুধু রান্নার পদ্ধতির কারণে”।
ট্রান্সফ্যাট খাদ্যে কিভাবে আসে?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: মুশতাক হোসেন বলছেন, তেল বার বার পোড়ালে তা থেকে অক্সিজেন চলে যায় ও তাতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয় আর এ ধরণের তেল দিয়ে কোনো কিছু ভাজলে সেটি মচমচে হয়।
“ডালডা, জিলাপি, সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি, পিয়াজি, বেগুনি, আলুচপ, নানা পদের বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি পণ্যে বা ফাস্ট ফুড তৈরিতে এ ধরণের তেল বেশি ব্যবহার করা হয় মচমচে করার জন্য,” বলেন মি. হোসেন।
মূলত প্রাকৃতিক বা শিল্প উৎস থেকে আসা অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডই হলো ট্রান্সফ্যাট বা ট্রান্স ফ্যাটি এসিড।
দুধ, মাখন, ঘি, গরুর বা ছাগলের মাংস হলো প্রাকৃতিক ট্রান্স ফ্যাটের উৎস, অন্যদিকে শিল্পক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ তেলের হাইড্রোজেনেশনের সময় ট্রান্সফ্যাট উৎপন্ন হয়। এই হাইড্রোজেনেটেড তেলই শিল্পে উৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস।
এমনকি রান্নার কাজে এক তেল বারবার পোড়ালেও তাতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হতে পারে।
আর ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার রক্তের খারাপ কোলেস্টরেল বাড়িয়ে দেয়, আর মাত্রা কমায় ভালো কোলেস্টরেলের। আর খারাপ কোলেস্টরেল রক্তবাহী ধমনীতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, বলছিলেন ডা: মুশতাক হোসেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষ মারা যায় তার ৪দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী এই ট্রান্সফ্যাট।
সংস্থাটি বাংলাদেশসহ ১১টি দেশকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছে।
সংস্থাটি ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করছে এবং তারা বলছে সব ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি একশ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই গ্রামে সীমিত করতে হবে।
যদিও তাদের হিসেবে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে নীতিমালা না থাকার কারণে ট্রান্সফ্যাট ঝুঁকিতে আছে।
বাংলাদেশে এখনো এ সম্পর্কিত কোনো নীতিমালা না থাকলেও নানা সংস্থা এগুলো নিয়ে সচেতনতার কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা বলছে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত দুই শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর গবেষকগণ।
“গবেষণায় ঢাকার পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি”।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা দুই শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য একটি নীতিমালা তৈরিতে কাজ শুরু করেছে তারা।
প্রতিরোধ কিভাবে সম্ভব?
ডা: হিমেল সাহা বলছেন ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগ থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় হলো স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ।
এর বাইরে আপাতত আর কোনো সমাধান নেই,” বলছেন তিনি।
ডা: মুশতাক হোসেন বলছেন, “মানুষকে সচেতন হতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম, প্রচুর পানি পান এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। তবে যেসব খাবার প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর তদারকির ব্যবস্থাও থাকা দরকার”।
Get the latest Zoom Bangla News first — Follow us on Google News, Twitter, Facebook, Telegram and subscribe to our YouTube channel.