জুমবাংলা ডেস্ক: ব্যবস্থাপত্রে বড় বড় ডিগ্রি, এমবিবিএস পাস না করেও তিনি সকল রোগের চিকিৎসক। নেই চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য করা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের লাইসেন্স। এমনকি সার্জারী ডাক্তার না হেয়েও করছেন অস্ত্রোপচারও। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। দায় নিজেও স্বীকার করেছেন। অথচ তিনি পল্লী চিকিৎসক। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর ইউনিয়নের লামা বাজার এলাকার শাহী মেডিকেল ফার্মেসিতে নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এই পল্লী চিকিৎসক চম্পা লাল দে।
আর.ডি.ভি (মৌলভীবাজার) ডি.এ.টি (ল্যাব), এম সি এইচ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল- এসব কোর্স করেই এমবিবিএস চিকিৎসকের মতোই করছেন জটিল সব রোগের চিকিৎসা। ডিজিটাল ব্যানার ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের নামে ভিজিটিং কার্ড ও প্যাড ছাপিয়ে আইন অমান্য করছেন প্রাথমিক চিকিৎসক চম্পা লাল দে।
নামের আগে পদবি লিখছেন ‘ডাক্তার’। তার ভুল চিকিৎসা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কারণে হরহামেশাই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। ডাক্তার রূপধারী এই পল্লী চিকিৎসকদের ওপর প্রশাসনের নজর বা নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই নেই। একারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন সেবা নিতে আসা শহর ও গ্রামের অসংখ্য মানুষ।
জানা যায়, আরএমপি, ডিএমএফ ও এলএমএএফ কোর্স করে নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে রোগী দেখলেও এই পল্লী চিকিৎসকদের রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। এই চিকিৎসকদের অনেকেই ন্যূনতম এসএসসিও পাস করেননি।
সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান এবং জটিল-স্পর্শকাতর রোগীদের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রেরণের নিয়ম। অথচ তিনি করছেন ঠিক এর উল্টো। চিকিৎসার নামে সাধারণ-জটিল সকল রোগের অপচিকিৎসা দিয়ে চলেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমলগঞ্জে ডাক্তার রূপধারী পল্লী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। উপজেলার তুলনায় গ্রাম-গঞ্জে এদের দৌরাত্ম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। চটকদার সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে নিজেদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ উপাধি আর ‘ডিপ্লোমা, প্যারামেডিক, এলএমএএফ, ডিএইসএস, শিশু বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার’—এর মতো নামে ভারী শব্দ লাগিয়ে দেদারছে অপ-‘চিকিৎসা-বাণিজ্য’ চালাচ্ছেন এরা। চেম্বার খুলে সাইনবোর্ডে নামের সঙ্গে ‘ডাক্তার’ উপাধি ও ডিগ্রির বহর যোগ করে এভাবেই প্রতারণা করে যাচ্ছেন।
গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট থাকায় এবং মানুষের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে বছরের পর রোগী দেখে যাচ্ছেন তারা। রোগমুক্তি তো দূরের কথা, এসব ভুয়া চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন হাজারো রোগী। এছাড়া মাঝেমধ্যেই তাদের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা যাওয়া মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময়-অসম্ভব করে ফেলছেন।
নিজের চেম্বার খোলার পাশাপাশি এসব পল্লী চিকিৎসক ওষুধও বিক্রি করছেন। নিজেই ডাক্তার, নিজেই আবার ওষুধবিক্রেতা। একারণে রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রাইবও করছেন দেদারসে। নিজেদের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গ্রামের অশিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত তথা গরিব মানুষদের আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে ফেলছেন এরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘পল্লী চিকিৎসকের কাছে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। সামান্য অসুখেও তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন জটিল রোগে। ফলে রোগ নিরাময়ে সময় বেশি লাগছে।’
অনেক রোগী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন। এতে পরবর্তী সময়ে একদিকে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছেন না, অন্যদিকে রোগীর খরচও বাড়ছে। এসব রোগীর রোগ নির্ণয়েও অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
জানা গেছে, বিভিন্ন বাজার ও গ্রাম-গঞ্জে শত শত লাইসেন্সবিহীন ডাক্তার নামধারী চেম্বার খুলে জাঁকিয়ে বসেছেন।
স্থানীয় ভু্ক্তভোগী ইমরান আলী জানান, ‘তার দুই বছরের শিশুর শরীরে ফোঁড়া হয়েছিল। পরে তিনি স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক চম্পা লাল দে এর কাছে যান। এ সময় তার ছেলেকে ভালো করার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু ভালো হওয়ার বদলে সেখানে ইনফেকশন হয়ে পচন ধরে।’
পরে তাকে সিলেট ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসক তাকে বলেছেন ভুল চিকিৎসার কারণে তার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে। পরে তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে ওই ব্যবসায়ীর।
ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে চম্পা লাল দে সহজে মৃত্যুর দায় স্বীকার করে বলেন, ‘যে রোগী মারা গেছেন আমার চিকিৎসায় সে চিকিৎসাটা দেওয়া আমার উচিত হয়নি। এছাড়াও উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন ও নিজে লেখছেন প্রেসকিপশনে এটা কি ঠিক? উত্তরে বলেন, আমার এসব করা ঠিক না। আপনার কি লাইসেন্স আছে পল্লী চিকিৎসকের উপড়ে? উত্তরে বলেন, সেটা সাথে নাই দেখাতে পারবো, বাসায় আছে। অনেক সময় দেখা যায় আপনি রক্ত আদান প্রদান করে থাকেন মানুষের শরীর থেকে; একজন পল্লী চিকিৎসক হয়ে আপনি কিভাবে এটা করেন? এটা ঠিক হয়নি আমার, আর হবে না।’
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল আহমেদ বলেন, ‘শুনেছি আমার এলাকার একজন মহিলা চিকিৎসারত অবস্থায় চম্পা লাল দে এর চেম্বারে মারা গেছেন। সে সময় আমি সিলেট ছিলাম জরুরী কাজে। তাই কিছু জানতে পারিনি।’
কমলগঞ্জ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন সব সময় যে কোন ধরনের অভিযোগ পেলে সাথে সাথে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকে। শমশেরনগর একটা ফার্মেসীতে রোগী মারা যাওয়ার বিষয়ে তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’
এ বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বিষয়টা আমার জানা ছিল না। আপনার কাছ থেকে জানলাম। আমরা হাসপাতাল থেকে একটা তদন্ত পাঠাবো। তদন্ত প্রতিবেদনের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, আমাদের লোকবল সংকটের কারণে অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় তদন্ত করা সম্ভব হয়না। তাছাড়া প্রায় সময় আমরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করি। সমস্যা দেখলেই আইনি ব্যবস্থা নিয়েও থাকি। তিনি বলেন, পল্লী চিকিৎসকের দ্বারা রোগী মারা যাওয়ার কোনো অভিযোগ আসেনি। আসলে বা জানতে পারলে ব্যবস্থা নিতাম। এছাড়া এখন আপনার কাছ থেকে এমন একটা অভিযোগ পেলাম। এখন স্থানীয় কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাকে বলে দিব বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।