ডাব্বাওয়ালাদের কাছে হার মানে ঘড়ির কাঁটা

ডাব্বাওয়ালাদের কাছে হার মানে ঘড়ির কাঁটা

জুমবাংলা ডেস্ক: ডাব্বাওয়ালা—যারা গৌরবের সঙ্গে মুম্বাই শহরকে প্রতিনিধিত্ব করেন। এই শহরের রিয়েল লাইফ হিরো একেক জন ডাব্বাওয়ালা। তারা শতাধিক বছর ধরে নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে আড়াই লাখ শ্রমজীবি মানুষের হাতে ঘরের খাবার পৌঁছে দেন। মুম্বাইয়ের পাঁচ হাজার ডাব্বাওয়ালার একজন অবনেশ দত্ত। সবাই ‘অবনেশ’ নামেই ডাকেন। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক তিনিই।

ডাব্বাওয়ালাদের কাছে হার মানে ঘড়ির কাঁটা

ডাব্বাওয়ালার দিনের শুরু
ঘড়ির কাটায় এখন ৯টা ছুঁই ছুঁই। সকালের নাস্তা না সেরেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অবনেশ। পাড়ার দোকানে এক কাপ গরম চা আর একটা রুটি দিয়েই দিন শুরু তার। রাস্তায় পরিচিতজনদের সঙ্গে একটু-আধটু খোশগল্প করেই সাইকেল নিয়ে দে-ছুট! কারণ গরম গরম খাবার নিয়ে তার অপেক্ষায় পাশের পাড়ার দিদিরা। এই সময়টায় মুম্বাইয়ে প্রতিটি পাড়াতেই অবনেশদের দেখা মেলে, যাদেরকে সবাই ‘ডাব্বাওয়ালা’ নামে চেনে।

অবনেশ দত্ত মুম্বাইয়ের ওল্ড কুলরা এলাকা থেকে ডাব্বা সংগ্রহ করে সাইকেল বোঝাই করে পৌঁছে গেলেন কাছের রেলস্টেশনে। সেই স্টেশনের নামও কুলরা। তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা ৪০ মিনিট বাজে। অবনেশের মতো অন্যান্য ডাব্বাওয়ালারাও বিভিন্ন জায়গা থেকে জড়ো হয়েছেন ডাব্বা নিয়ে। ডাব্বার গায়ে থাকা কোড অনুযায়ী, ডাব্বা বাছাই করা শুরু হল। প্রত্যেকটি এলাকার জন্য নির্দিষ্ট কোড আছে। অবনেশের সংগ্রহ করা বেশিরভাগ ডাব্বা চলে গেল অন্য ডাব্বাওয়লার কাছে। এবার ট্রেনে করে শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকায় যাবে ডাব্বাওয়ালাদের টিম। অবনেশও ডাব্বাওয়ালাদের একটা টিমে ঢুকে পড়লেন। এখন তিনি প্রায় ৩০টি নতুন ডাব্বা বইছেন। যেগুলো তার এলাকার নয়।

অবনেশ আর তার দলের লোকেরা টিফিন-বক্সগুলো হেড ক্রেটে (মাথায় বইবার কাঠের বিশেষ পাটাতন) তোলেন। এক একটা হেডক্রেটে থাকে ৬০টা টিফিন বক্স। আন্দাজ করতে পারছেন ওজনটা! অন্তত ৩০ কেজি থেকে এক মন তো হবেই! তারপরও আপনি ভাবতে থাকুন, ততক্ষণে অবনেশ মাথায় ৬০টা টিফিন বক্স নিয়ে ছুটতে শুরু করেছেন রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে।

মুম্বাইয়ের ব্যস্ত সময়ের জনাকীর্ণ রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে, গিজগিজ করা আমজনতাকে মেসির মতো ডজ করতে করতে এগিয়ে যান অবনেশ। কারণ তাকে দ্রুত এগোতে হবে। রেলের ওভারব্রিজ দিয়ে উঠে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে আসেন অবনেশ। তাকে নির্দিষ্ট ট্রেন ধরতেই হবে। না হলে টিফিন লেট হয়ে যাবে। কোনো অজুহাত শোনা হবে না।

ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় ডাব্বাওয়ালাদের ভিড়। ট্রেনে উঠে পড়েন অবনেশ। মাথা থেকে ক্রেটটি নামান। ট্রেনযাত্রার এই সময়টুকু ডাব্বাওয়ালাদের বিশ্রামের সময়। ডাব্বাওয়ালারা নিজেদের সুখ দুঃখের কথা ভাগ করে নেন। একের পর স্টেশন পেরিয়ে যায়। ডাব্বাওয়ালাদের প্রত্যেকটি দলকে নির্দিষ্ট স্টেশনের জন্য বরাদ্দ করা আছে। অবনেশ তার টিমের সঙ্গে নামলেন চার্চগেট স্টেশনে। এই ট্রেনের শেষ স্টেশন।

বেলা তখন ১২ টা। আর সময় নেই হাতে। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত দৌড়াচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার চেয়েও দ্রুতবেগে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছেন শত শত ডাব্বাওয়ালা। দৌড়াতে শুরু করেছেন অবনেশ। চার্চগেট স্টেশনের বাইরে ডাব্বাওয়ালাদের ভিড়। শেষ ধাপের গন্তব্যগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোড অনুযায়ী আবার ডাব্বা বাছাই শুরু হল। ট্রেনে করে নিয়ে আসা অবনেশের ডাব্বাগুলো চলে গেল অন্য ডাব্বাওয়ালার কাছে। আবার একটি নতুন দলে ঢুকে পড়লেন অবনেশ। এবার ডাব্বাগুলো বোঝাই করা হল একটি ট্রলিতে। দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করল ট্রলি, বিভিন্ন অফিস, বিজনেস সেন্টার, স্কুল কলেজ, কোর্ট, ব্যাংকের দিকে।

প্রতিটি ডাব্বাতেই থাকে নির্দিষ্ট কোড
দুপুরে মুম্বাইয়ের সব এলাকাকে আঁকড়ে থাকে ট্র্যাফিক জ্যাম। ঝাঁকা-মুটেদের মতই চিৎকার করতে করতে ডাব্বাওয়ালারা এগিয়ে চলেন ট্রলি নিয়ে। পথচারীরা রাস্তা ছেড়ে দেন। কারণ তারা জানেন ডাব্বাওয়ালারা থামতে জানেন না। তাদের জীবন মানেই দৌড়। মুম্বাই শহরের মানুষ এও জানেন, প্রতি ষাট লাখ টিফিন বক্স নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র একবার দেরি করে ফেলেন সুতির সাদা কুর্তা পাজামা, মাথায় গান্ধী টুপি পরা ডাব্বাওয়ালারা। ১৯৯৮ সালে বিশ্বখ্যাত ব্যবসাবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’ ডাব্বাওয়ালাদের নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিল। ‘সিক্স সিগমা দক্ষতা রেটিং’-এ (Six Sigma) ডাব্বাওয়ালারা ৯৯.৯৯৯৯ নম্বর পেয়ে হতবাক করে দিয়েছিলেন বিশ্বকে।

যাহোক, বিজনেস হাবে পৌঁছে অবনেশের টিম আবার ভেঙে গেল। প্রত্যেক ডাব্বাওয়ালা এবার আলাদা আলাদা বিল্ডিংয়ে ডাব্বা ডেলিভারি করবেন বিল্ডিংয়ের সাংকেতিক নম্বর অনুযায়ী। আবার শুরু হয় বহুতলে ওঠানামা। যারা ভাগ্যবান তাদের কপালে জোটে লিফটওয়ালা বিল্ডিং। অবনেশকে ছ’টা বিল্ডিংয়ে দিতে হবে ৩০টি লাঞ্চ-বক্স। তারমধ্যে তিনটি ভবনে লিফট নেই, প্রচুর সিঁড়ি বাইতে হবে।

কাঁটায় কাঁটায় দুপুর একটা। অবনেশসব ডাব্বা ডেলিভারি করে দিয়েছেন। একই সময়ের মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ ডাব্বাওয়ালা প্রায় ২২ লাখ লাঞ্চ-বক্স ডেলিভারি করে দিয়েছেন। নিশ্চিন্ত অবনেশ, গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে পার্কে এসে বসেন। চলে আসেন আরও ডাব্বাওয়ালা। নিজেদের আনা খাবার খান ভাগ করে। পাঠকরা ভাবছেন, ক্লান্ত অবনেশ এখন বিশ্রাম করবেন, নয়তো বাড়ি ফিরবেন। না, অবনেশকে আবার ফিরতে হবে কাজে। আবার বহুতলের তলায় তলায় পৌঁছে খালি ডাব্বা সংগ্রহ করে আবার গ্রাহকদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই একই পদ্ধতিতে এবং তা করতে হবে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে!

আবার দৌড়াতে শুরু করেন অবনেশ। বৌয়ের ফোন আসে বাড়ি থেকে, মেয়েটার জ্বর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি অস্ফুটে বলেন ‘সন্ধ্যা ৬ টার পর…সন্ধ্যা ৬ টার পর, প্লিজ একটু বোঝো’।

এভাবেই মুম্বাই নগরীতে প্রায় পাঁচ হাজার ডাব্বাওয়ালা অন্তত দুই লাখ ডাব্বা বা টিফিন বক্স প্রতিদিন ঘর থেকে অফিসে সরবরাহ করে, আবার অফিস থেকে ঘরে পৌঁছে দেয়। বিশ্বাস করুন, প্রায় ১২০ বছরের ইতিহাসে তাদের বিরুদ্ধে দেরি কিংবা বাক্স ওলট-পালটের ঘটনা শতকরা ১ ভাগও বোধহয় নেই।

শুরুটা ১৮৯০ সালে, এখন সংকটে
সেই ১৮৯০ সালের কথা, ভারতবর্ষে তখনও রমরমা অবস্থা ব্রিটিশদের। তাদেরই প্রয়োজনে মুম্বাইয়ের অফিসগুলোতে বাড়িতে তৈরি খাবার পৌঁছে দেবার জন্য যাত্রা শুরু করে ডাব্বাওয়ালারা। ১০০ জন লোকবল নিয়ে কাজ শুরু করেন মহাদেব হাভাজি বাচ্চে। সেই ১০০ জন থেকে বেড়ে একসময় ডাব্বাওয়ালার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৫০০-তে; যাদের মোট গ্রাহক ছিলেন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার।

১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘মুম্বাই টিফিন বক্স সাপ্লায়ারস্ অ্যাসোসিয়েশন’। আজ সাড়ে পাঁচ হাজার ‘ডাব্বাওয়ালা’, রোজ প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রাহকের কাছে গ্রাহকদের বাড়ির খাবার পৌঁছে দেন। সংস্থাটির বার্ষিক আয় এখন বেতনের খরচ বাদ দিয়ে ৬০ কোটি টাকা। রমরমিয়ে চলছে ব্যবসা, অথচ নেই ন্যূনতম প্রশিক্ষণ, নেই সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। তারপরও ভারতের অভ্যন্তরে এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইদানীং মুম্বাইয়ের এই ডাব্বাওয়ালাদের তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে আমন্ত্রণ জানায়। ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজকুমার চার্লসের বিয়েতেও তাদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

মগের মুল্লুক হয়ে উঠলো যেভাবে