নক্ষত্রের গতি ব্যবহার করে প্রথম ডার্ক ম্যাটারে প্রস্তাব করেন ডাচ জ্যোতির্বিদ জ্যাকোবাস ক্যাপটেইন। আরেক ডাচ বিজ্ঞানী ও রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমার জ্যান উর্ট ১৯৩২ সালে একই কাজ করেন। তিনি কাজ করেছিলেন লোকাল গ্রুপের গ্যালাক্সিদের গতি নিয়ে। লোকাল গ্রুপ হলো আমাদের মিল্কিওয়ে ও এর আশপাশের অন্তত ৫৪টি গ্যালাক্সির একটি সমাবেশ।
আরেকটু বড় আকারে কাজ করেন সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিৎজ জুইকি। ১৯৩৩ সালে তিনি বিভিন্ন রকমের গ্যালাক্সিপুঞ্জ নিয়ে কাজ করে অদেখা ভরের প্রমাণ হাজির করেন। তিনি বিশেষ করে নজর দেন কোমা ক্লাস্টার নামের গ্যালাক্সিপুঞ্জের দিকে। তিনি এই ক্লাস্টারের প্রান্তের দিকের গ্যালাক্সিদের বেগ পরিমাপ করেন।
এবার একে তুলনা করেন মোট গ্যালাক্সির সংখ্যা ও তাদের উজ্জ্বলতার সঙ্গে। হিসাব করে দেখলেন, যতটুকু ভর দেখা যাচ্ছে সত্যিকারের ভর হচ্ছে তার ৪০০ গুণ। দৃশ্যমান গ্যালাক্সিগুলোর যে ভর, তাতে এত বাইরের প্রান্তীয় গ্যালাক্সির ক্লাস্টারের অংশ হওয়ার কথা নয়। অতএব ক্লাস্টারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিশ্চয় কোনো অদেখা ভর ভূমিকা রাখছে।
১৯৩৯ সালে ব্যাবক অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটার থাকার ইঙ্গিত খুঁজে পান। ১৯৪০ সালে জ্যান উর্ট এনজিসি ৩১১৫ গ্যালাক্সিতে পান এই ইঙ্গিত। ডার্ক ম্যাটার নিয়ে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কাজ হয় ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে। ভেরে রুবিন, কেন্ট ফোর্ড ও কেন ফ্রিম্যান এই কাজগুলো এগিয়ে নেন। রুবিন ও ফোর্ড কাজ করেছিলেন একসঙ্গে। তাঁরা দেখান, বেশির ভাগ গ্যালাক্সিতেই দৃশ্যমান ভরের ছয় গুণ আছে অদৃশ্য ভর।
এসব কাজের মাধ্যমে ১৯৮০ সালের দিকে ডার্ক ম্যাটার জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পরে হিসাব করে দেখা যায়, রহস্যময় এই পদার্থ দিয়েই গড়া মহাবিশ্বের ৮৫ শতাংশ বস্তু। আর সম্পূর্ণ ভর-শক্তির চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি (২৭ শতাংশ)।
২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা চমকপ্রদ একটি খবর প্রকাশ করেন। তাঁরা এমন একটি গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেছেন, যাতে নেই কোনো ডার্ক ম্যাটার। নাম এনজিসি ১০৫২-ডিএফ২। বা সংক্ষেপে ডিএফ২। এটি আছে ৬.৫ আলোকবর্ষ দূরে। আকার আমাদের মিল্কিওয়ের প্রায় সমান। তবে নক্ষত্রের সংখ্যা অনেক কম। মিল্কিওয়ের ২০০ গুণ কম। এবার জ্যোতির্বিদেরা পেয়েছেন এমন আরেকটি গ্যালাক্সি। পাশাপাশি আগের গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটার না থাকার প্রমাণও আরও জোরালো করেছেন।
গবেষণাটি প্রকাশ করেছে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স। গবেষণাপত্রের মূল অথর শ্যানি ড্যানিয়েলি। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ নতুন কিছু দেখছি, এটা খুবই দারুণ বিষয়। কেউ জানত না, এমন গ্যালাক্সিও থাকতে পারে। জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর হলো কোনো একটি বস্তু আবিষ্কার করা। সেটা হতে পারে কোনো গ্রহ, নক্ষত্র, বা গ্যালাক্সি।’
তাঁরা দেখিয়েছেন, ডিএফ২ গ্যালাক্সির নক্ষত্র স্তবকগুলো গ্যালাক্সির দৃশ্যমান ভরের সঙ্গে মিল রেখেই ঘুরছে। ডার্ক ম্যাটার না–থাকা আরেকটি গ্যালাক্সি হলো ডিএফ৪। এটা পাওয়া গেছে আগের মতোই কেক অবজারভেটরি যন্ত্রের মাধ্যমে। তবে আগেরবার ব্যবহার করা হয়েছিল কেক কসমিক ওয়েব ইমেজার (KCWI)। আর এবার ব্যবহার করা হয়েছে লো রেজল্যুশন ইমেজিং স্পেকট্রাম (LRIS)।
ডিএফ২ ও ৪ দুটোই এক বিশেষ ধরনের গ্যালাক্সি। নাম ইউডিজি (UDG)। বাংলায় অতিমাত্রায় বিক্ষিপ্ত গ্যালাক্সি। এর মানে হলো নক্ষত্রগুলো নিজেদের থেকে অনেক দূরে দূরে আছে। আগেই বলেছি, ডিএফ২ মিল্কিওয়ের প্রায় সমান। কিন্তু নক্ষত্র আছে ২০০ গুণ কম। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের সংখ্যা ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন। যদি ১০০ বিলিয়নও ধরি, তবু ডিএফ২–তে নক্ষত্রের সংখ্যা হয় মাত্র ৫০ কোটি। কোথাও ১০ হাজার কোটি, আর কোথাও ৫০ কোটি। এ জন্যই এমন গ্যালাক্সির নাম অতিমাত্রায় বিক্ষিপ্ত।
তাহলে কোনো গ্যালাক্সি ডার্ক ম্যাটার না থাকার অর্থ কী? এর মানে কি এই যে ডার্ক ম্যাটার তত্ত্ব হুমকির মুখে পড়ল? আসলে কিন্তু তার বিপরীত। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, এই রহস্যময় বস্তুগুলো সাধারণ বস্তুর সঙ্গে জড়িত নয়। এ ছাড়া গবেষণার সুযোগ হবে যে ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্যের অভাবে গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটার থাকে না। অন্য অর্থে ডার্ক ম্যাটারের রহস্য সমাধানের একটি পথ ডার্ক ম্যাটার না–থাকা গ্যালাক্সিগুলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।