জুমবাংলা ডেস্ক : আনোয়ারা বেগম একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার স্বামী দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত, সবাই দেশের বাইরে থাকেন। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। এরমধ্যে তিনি কিছুটা পারিবারিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন। ফলে এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন তিনি।
এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন ফেসবুক স্ক্রল করার সময় তার সামনে একটি বিজ্ঞাপনের ভিডিও আসে। ভিডিওতে দেখা যায়, একজন দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখায়, যেখানে তাদের বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশ বাবার কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।
ভিডিওটি দেখে আনোয়ারা তার বাসার গৃহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করেন। গৃহকর্মী তাকে জানান, জীন-পরীর মাধ্যমে দরবেশ বাবারা এসব সমস্যার সমাধান করে থাকেন। তার গ্রামের কয়েকজনের এভাবে সমস্যার সমাধান হয়েছে।
গ্রহকর্মীর কথায় আনোয়ারা বেগম উৎসাহিত হন এবং বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করেন। ফোন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপন দেয়া দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি খুব সুন্দর করে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। তিনি তখন তার পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা দরবেশ বাবার সঙ্গে আলোচনা করেন।
দরবেশ বাবা সমস্যার কথাগুলো শুনে তাকে বলেন, “মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখো। আমি তোমাকে ‘মা’ বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যা সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরও বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।”
সুন্দর ব্যবহার ও কথা বলে দরবেশ বাবা তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে বলেন। দরবেশ বাবার সুন্দর ব্যবহার ও কথায় তার ভক্ত হয়ে যান আনোয়ারা। তিনি দরবেশ বাবার কথামতো বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে দরবেশ বাবা আনোয়ারার কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। পরে একসময় আনোয়ারা যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন, তখন প্রতিকার পাওয়ার জন্য মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন এবং সিআইডি প্রধানের বরাবর অভিযোগ করেন।
পরবর্তীতে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে। এর প্রেক্ষিতে শনিবার রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার হন অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসান।
তানজিলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের হোতা মো. হাসেম বোরহানুদ্দিন। হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অঙ্কের টাকা নিতেন। এরপর বড় অঙ্কের টাকা নেয়ার জন্য তানজিলকে আনোয়ারার কাছে পাঠাতেন। আনোয়ারার কাছ থেকে একেকবারে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেতেন তানজিল। এভাবে ধাপে ধাপে তারা প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভুক্তভোগী আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে।
জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের হোতা হাসেম বর্তমানে ভোলায় অবস্থান করছে বলেও জানান তানজিল। তার তথ্যের ভিত্তিতে ভোলায় অভিযান চালিয়ে পরবর্তীতে হাসেমকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ‘প্রতারক হাসেম ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছে। প্রথম দিকে সে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি সে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করে। প্রতিমাসে ফেসবুকে অন্তত চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিত সে। শুধু তাই নয়, তার বিজ্ঞাপন বেশি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পোস্ট বুস্ট করত।
‘মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে হাসেম সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এছাড়াও সে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি এবং ফ্রান্সেও বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এভাবে সে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলত ও তাদের থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিত।’
তিনি বলেন, ‘হিন্দি ও আরবি ভাষাসহ বিভিন্ন কণ্ঠে কথা বলতে পারে প্রতারক হাসেম। ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেনের কাছে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে তাকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সে। এছাড়া অন্য আরেকজন ইতালী প্রবাসীর কাছ থেকে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেয়ার কথা বলে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’
সিআইডি জানায়, প্রবাসী ইমাম হোসেন এক পর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলেন। বড় বোন তার ছেলের ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দেন।
সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এরকম অন্তত ২০-২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে; মালয়েশিয়াতে আছে ১০-১২ জন। এর মধ্যে ৫-৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছেন যারা গত ৪-৫ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ বাবারুপী প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।