এম এ খালেক: চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকে চেয়ে দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ২৯ বছরে এটাই চীনের সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কয়েক দশক ধরে চীন উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছিল। ২০১০ সালের আগের তিন দশক চীন গড়ে ১০ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কট্টর সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে চীন নিজেদের ক্রমশ সরিয়ে এনে মুক্ত বাজার অর্থনীতির পথে চালিত হয়েছে।
তবে তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলেও মার্কিনি ধাঁচের মুক্ত বাজার অর্থনীতি তারা গ্রহণ করেনি। বরং চীন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে নিজেদের দেশের উপযোগি করে বাস্তবায়ন করছে।
অনেকের মনেই বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে এটা ভেবে যে চীনের মতো জনবহুল একটি দেশ কিভাবে এত উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, চীনের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশেষ ভাবে কাজ করেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা সঠিকভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারা। একটি দেশের যখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সূচনা হয় তখন সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। দেশটি দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে সেই অবস্থা যখন একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা তারও বেশির বয়সী থাকে ১৫ বছর হতে ৬০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ দেশের দুই-তৃতীয় অংশই হবে কর্মক্ষম। একটি জাতির জীবনে এই অবস্থা একবারই আসে। আবার কারো কারো মতে, এই অবস্থা একটি জাতির জীবনে হাজার বছরে একবার আসে। যে জাতি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তারাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছর স্থায়ী হয়। বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান বেশ কয়েক দশক আগে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রম করে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ বা প্রবীণ লোকের সংখ্যা বেশি। তারা ক্রমশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। কয়েক বছর আগে জাপান বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের আধিপত্য হারিয়ে ৪৪ বছর পর চীনের নিকট দ্বিতীয় পরাশক্তির অবস্থান খুঁইয়েছে। জাপানকে অতিক্রম করে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। ভারতও বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। তবে তারাও এই অবস্থার সুযোগ আর বেশি দিন পাবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অবস্থা কি? বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে চলেছে। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক দেশের জন্যই ইর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে (২০১৮-’১৯) বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স এখন ১৫ হতে ৬০ বছরের মধ্যে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য।
তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থাকে সঠিকভাবে পরিপূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এখনো সময় আছে আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুবিধা পুরো মাত্রায় কাজে লাগানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে সবার আগে যে কাজটি করতে হবে তাহলে প্রতিটি নাগরিককে তার উপযুক্ততা অনুযায়ী প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। জনসংখ্যা এমনই এক অর্থনৈতিক উপকরণ যা একই সঙ্গে ‘সম্পদ’ এবং ‘দায়’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে তোলা যায় তাহলে জনসংখ্যা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কারণ যে কোনো উন্নয়ন কাজের জন্যই দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন। আবার জনসংখ্যা যদি অপ্রশিক্ষিত এবং অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠে তা হবে সবচেয়ে বড় একটি রাষ্ট্রীয় দায়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে এখনো আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারিনি। বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান করছে। তারা বছরে প্রচুর পরিমাণ রেমিটেন্স প্রেরণ করছে। ২০১৮-’১৯অর্থ বছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স প্রেরণ করেছে। এটা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিটেন্স। বাংলাদেশ যদি প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ পেশাজীবীদের বিদেশে প্রেরণ করতে পারতো তাহলে বিদ্যমান প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমেই কয়েক গুণ বেশি রেমিটেন্স আহরণ করা যেতো। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতি বছর যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছে তার একটি বড় অংশই আবার বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি এক্সপার্টদের বেতন-ভাতা পরিশোধে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলকারখানায় যে সব বিদেশি এক্সাপার্ট কাজ করছে তাদের পেছনে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা যদি দক্ষ জনশক্তির যোগান দিতে পারতাম তাহলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশেই থেকে যেতো।
বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। এই অবস্থা চির দিন থাকবে না। ২০৩০-২০৩৫ সালের মধ্যেই এই অবস্থার অবসান ঘটতে শুরু করবে। তখন চাইলেও আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাঙ্খিত মাত্রায় ত্বরান্বিত করতে পারবো না। তাই এখনই আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়বো।
এম এ খালেক : অর্থনীতি বিষয়ক কলাম লেখক (অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।