জুমবাংলা ডেস্ক : এক দশক আগেও দেশে ড্রাগন ফলের উৎপাদন তেমন ছিল না। বছর ছয়েক আগে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হওয়া এই ফলের উৎপাদন ছাড়িয়েছে এক কোটি কেজি বা ১০ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা।
ড্রাগন ফলের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক হচ্ছে ঝিনাইদহ ও যশোর জেলায়। কৃষকের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা প্রদানকারী ফলের অন্যতম ড্রাগনের চাষ এখন সারা দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ঝিনাইদহে ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয় ২০১৪ সালের পর। গত অর্ধযুগের ব্যবধানেই ড্রাগন ফল আবাদে শীর্ষে উঠে এসেছে জেলাটি। এখন দেশের মোট উৎপাদনের ৩৯ শতাংশ বা প্রায় ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার কেজি উৎপাদন হচ্ছে এই জেলায়। ড্রাগন ফল আবাদের মাধ্যমে এই অঞ্চলের কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি পুষ্টি নিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখছেন। পাশাপাশি শস্য আবাদে বৈচিত্র্য আসছে জেলায়, বিশেষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা এখন প্রথাগত ধানের আবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফলের আবাদে ঝুঁকছেন।
ড্রাগন ফল উৎপাদনে এর পরই যশোরের অবস্থান। জেলায় ৯ লাখ ৬৫ হাজার কেজি ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে গত অর্থবছরে। এ ছাড়া নাটোর জেলায় ছয় লাখ ৪০ হাজার কেজি, নারায়ণগঞ্জে তিন লাখ ৯৫ হাজার এবং রাজশাহীতে তিন লাখ ২৫ হাজার কেজি ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে।
উৎপাদন ও বাণিজ্য
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ড্রাগন ফলের উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৬ হাজার কেজি। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা উন্নীত হয়েছে প্রায় ৮৬ লাখ ৫৯ হাজার কেজিতে। সদ্যঃসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন প্রায় কোটি কেজি হয়েছে বলে মাঠ পর্যায় থেকে প্রাথমিক তথ্যে উঠে এসেছে।
বরগুনার খোলপটুয়া ড্রাগন চাষি মাওলানা ইউসুফ আলী জানান, তিন বছর ধরে তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন। বছরে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি প্রতিবছর চার লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেন। তবে শুরুতে বাগান তৈরির সময় ৪০ শতাংশ জমিতে চারা ও আনুষঙ্গিকসহ পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। বর্তমানে সার, ওষুধ ছাড়া আর কোনো খরচ নেই।
কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সাধারণত ফলের মৌসুম শেষ হয় জুন ও জুলাই মাসে। এর পরই ড্রাগন ফলটি বাজারে আসতে শুরু করে। মৌসুমের শুরুতে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের দাম ২০০ টাকার বেশি থাকে। আগস্ট মাসে যা প্রতি কেজিতে আড়াই শ টাকা পর্যন্ত পান কৃষকরা। রাজধানীর বাজারে ড্রাগন ফল প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে ৩০০ টাকা কেজি ধরলে ফলটির বর্তমান বাজার প্রায় ২৫৯ কোটি টাকার।
২০ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার প্রকৌশলী শাহিনুর রহমান। ২০২০ সালে প্রথমে ১০ বিঘা এবং পরে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে আরো ১০ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু করেন তিনি। গত দুই বছরে তিনি প্রায় ১৯ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সার্বক্ষণিক ১০ জন মানুষ কাজ করেন।
কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় ১২ জন চাষি ৩০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করেছেন। ভালো ফল পেয়ে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার কাশীপুর মাঠপাড়ার কৃষক রূপ মিয়া ১০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন সাত বছর ধরে। তিনি জানান, ওই জমিতে ড্রাগন চাষে তাঁর প্রতিবছর ব্যয় হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তবে ফল বিক্রি করেন প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকার। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগনের চারা বিক্রি করে আরো প্রায় ২০ লাখ টাকা আয় হয় বছরে।
পুষ্টি
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ২০০ গ্রাম পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল খাওয়া প্রয়োজন। এই চাহিদার বিপরীতে দেশের মানুষ গড়ে ফল খাচ্ছে মাত্র ৮২ গ্রাম। তাই জনপ্রতি প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ১১৮ গ্রাম। আবার যে ফল পাওয়া যায় তা শুধু কয়েক মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মৌসুমি ফল শেষ হওয়ার পর আসায় ড্রাগন এই সময়ের ফলের চাহিদা পূরণ করছে।
ড্রাগন ফলে প্রচুুর পরিমাণে পটাসিয়াম, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ‘বি’, ভিটামিন ‘বি’ কমপেক্স রয়েছে। এ ছাড়া এতে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড রয়েছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধী। এটি শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দিতে সহায়তা করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, পুষ্টি নিরাপত্তা ও কৃষকের অর্থিক সচ্ছলতার কারণে দেশে ড্রাগন ফলের আবাদ বাড়ছে।
জাত উন্নয়ন
২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রথম থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে ড্রাগন ফলের বিভিন্ন জাত আনা হয় দেশে। স্বল্পপরিসরে জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে একাধিক প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে পাইলট আকারে দেশের বিভিন্ন জেলায় আবাদ শুরু হয়। ২০১৫ সালে এটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। বিভিন্ন জাত রয়েছে ফলটির। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বাউ ড্রাগন-১ ও ২ এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বারি ড্রাগন-১ এখন বেশি চাষ হয়। বাউ ড্রাগন-১-এর ভেতরের অংশ সাদা। বাউ ড্রাগন-২ ও বারি ড্রাগন-১-এর ভেতরের অংশ লাল। এ ছাড়া পিংক, ভেলভেট ও হলুদ রঙের ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে এখন।
ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ জানান, ড্রাগন ফলের বাগান তৈরির পর সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উৎপাদন খরচ কম থাকায় কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন। এক একর জমিতে ড্রাগন ফলের আবাদ করে বছরে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা পাচ্ছেন কৃষক। শহরাঞ্চলে ফলটির আবাদ ছাদ বাগানেও হচ্ছে। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ড্রাগন ফল আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে।
মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘আমরা সমতল ছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চলে আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। উৎপাদন আরো বেশি হলে আমরা ফলটি রপ্তানির উদ্যোগ নেব।’ সূত্র : কালের কন্ঠ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।