জুমবাংলা ডেস্ক: ঢাকার কোরবানির চামড়া কেনাকাটা শুরু হয়েছে। পুরান ঢাকার পোস্তায় চামড়ার বড় পাইকারি বাজার এবং হেমায়েতপুরে বাজার থেকে ট্যানারির মালিকরা কিনছেন চামড়া। আজ গ্রামের লবণমিশ্রিত চামড়াগুলো ঢাকায় আসা শুরু হবে। কারণ ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিন পর্যন্ত জেলা থেকে ঢাকামুখী এবং আন্তঃজেলায় কুরবানির পশুর চামড়াবাহী কোনো পরিবহণ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। যার সময়সীমা শনিবার শেষ হয়েছে। তবে আন্তঃজেলার আড়তগুলোতে লবণ মেশানো চামড়া বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অব্যাহত আছে। এসব চামড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই কেনাবেচা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, রোববার থেকে বিভিন্ন জেলার চামড়া ঢাকায় আসা শুরু হবে। এরইমধ্যে ঢাকায় চামড়া কেনাকাটা শুরু হয়েছে। তবে তার অভিযোগ-ট্যানারি থেকে নির্গত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনও ভালো হয়নি। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ট্যানারিকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না এবং ছাড়পত্র নবায়নও করছে না। তিনি আরও বলেন, আজকে ছাড়পত্র পেলে এবং অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক করলেও এলডিব্লউজি সনদ পেতে ২ বছর সময় লাগবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আগামীতে চামড়ার মূল্য বাজারে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা থাকছেই।
এদিকে পোস্তায় সাভারের ট্যানারির মালিকরা স্বল্প পরিসরে কেনাকাটা করছেন বলে জানান বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসাসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. আলী হোসেন। তিনি আরও বলেন, তারল্য সংকট সবার। এজন্য কেনাকাটাও ধীরগতিতে হচ্ছে। রোববার বাজার পুরোদমে জমে উঠবে বলে আশা করছেন। আশা করছি এবার চামড়ার দর নিয়ে খুব একটা ঝামেলা হবে না। সরকার যে দাম ঠিক করে দিয়েছে সেই রেট মোতাবেকই সবাই কিনবে। এতে সবপক্ষই লাভবান হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ আড়ত এখনও দরদাম আর যোগাযোগের পর্যায়েই রয়ে গেছে। কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারী দেশের সবচেয়ে বড় আড়ত পোস্তায় সরবরাহ কম থাকায় কেনার সময় গতবারের চেয়ে এবার দাম একটু বেশি দিতে হয়েছে। যে কারণে ব্যবসায়ীরা বিক্রির বেলায় একটু রয়েসয়ে বাজার যাচাই করে চামড়া ছাড়ার চেষ্টায় আছেন।
ট্যানারির প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন আড়তে গিয়ে দরদাম করছেন। দামে বনিবনা হলে সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরীতে চামড়া নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। অনেকে আড়তদারদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে রাখছেন, নিয়মিত খবরাখবর নিচ্ছেন। আড়তদারদের কেউ কেউ আবার সাভারে গিয়ে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে দর নির্ধারণের বিষয়ে কথা বলছেন। এরমধ্যে কিছু ট্যানারি বুধবার রাত থেকে কেনা শুরু করে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার কিছু আড়ত থেকে চামড়া ট্রাকে তুলতে দেখা যায়।
জানা গেছে, অন্যান্য বছরে তিন লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পোস্তার চামড়ার আড়তগুলোর। কিন্তু এ বছর এক লাখ পিস সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ৮০ শতাংশ পূরণ হয়েছে। পোস্তায় ভিড় কম হওয়ার পেছনে আড়তদাররা মনে করছেন, সাভার ও হেমায়েতপুরের ট্যানারি ব্যবসায়ীদের অনেকে নিজেদের অর্থ দিয়ে সরাসরি চামড়া সংগ্রহ করে কিনে ফেলছেন। এদিকে শনিবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় চামড়ার বড় হাট বসায় ট্যানারিগুলোর নজর সেদিকেই ছিল বেশি। তবে হাটে নিয়ে আসা অনেকে চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না এমন অভিযোগও করেছেন। কিন্তু ট্যানারি মালিকের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত দামেই তারা কেনাকাটা করছেন। ঈদের দিন এবার গরুর চামড়া পাইকাররা কিনেছেন আকার ও অবস্থাভেদে গড়ে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। ছোট আকারের গরুর চামড়া ৩০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় আকারের চামড়া বিক্রি হয় ৮০০ টাকায়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৪৭ থেকে ৫২ টাকায়। আর ঢাকার বাইরে এই দাম হবে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। দুই ক্ষেত্রেই গতবারের চেয়ে দাম বেড়েছে ৭ টাকা। এছাড়া লবণযুক্ত খাসির চামড়া সারা দেশে ১৮ থেকে ২০ টাকায় কিনবে ট্যানারি, যা আগেরবারের চেয়ে ৩ টাকা বেশি।
সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে চাপ নেই : সাভার থেকে মতিউর রহমান ভাণ্ডারী জানান, সিইটিপির (সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার) ওপর চাপ কমাতে ঢাকার বাইরের চামড়া ধাপে-ধাপে আনার সিদ্ধান্ত নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ফলে এ বছর সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কাঁচা চামড়ার ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। এ বছর কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ চাপ কম থাকলেও তরল বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। শনিবার বিকালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
সিইটিপির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লি.র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার সুযোগ নেই কারণ আমাদের বেশ কিছু লোক এ বিষয়টি নজরদারি করছেন। এরপরও কেউ গোপনে বর্জ্য ফেলে থাকলে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ক্রেতার অপেক্ষায় চট্টগ্রামের আড়তদাররা : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, এক সপ্তাহ পরও কুরবানির পশুর চামড়ার ক্রেতা পাননি চট্টগ্রামের আড়তদাররা। ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তারা। এবার আড়তদাররা লাভের আশা করলেও চামড়া বিক্রির টাকা নগদে পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত। কেননা এর আগের চামড়া বিক্রির ৩০ কোটি টাকা এখনও আটকে রেখেছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। সেই টাকা না পেয়ে অনেক আড়তদার দেউলিয়া হয়ে গেছেন। আড়তদাররা আশা করছেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে চট্টগ্রাম আসতে শুরু করবেন। এর মধ্যে কয়েকজন ট্যানারি মালিক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চামড়া কেনার আগ্রহও দেখিয়েছেন। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোই কিনে থাকে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, এবার চট্টগ্রাম অঞ্চলে কুরবানিদাতা কমে যাওয়ায় চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। চট্টগ্রাম নগরীর ৪৫ জন আড়তদার ১ লাখ ৫৩ হাজার পিস কাঁচা চামড়া কিনেছেন। লবণ দিয়ে তারা এগুলো নিজ নিজ আড়তে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এসব চামড়ার ক্রেতা মূলত ট্যানারি মালিকরা। তারা কিনে নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করবেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের রিফ লেদার নামের ট্যানারি এবার স্থানীয় আড়তদারদের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার পিস চামড়া কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাকি প্রায় ১ লাখ চামড়া বিক্রি করতে হবে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। তাই তাদের পথ চেয়ে বসে থাকা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই।
আড়তদাররা আরও জানান, এর মধ্যে ঢাকার তিনটি ট্যানারি চট্টগ্রাম থেকে চামড়া কিনে নিয়ে গেছে। তা পরিমাণে অল্প, প্রায় তিন হাজারের মতো। এসব চামড়া থেকে কিছুটা লাভ পেয়েছেন আড়তদাররা। তাই বাকি চামড়াগুলো থেকেও লাভের মুখ দেখবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছেন। বড় পার্টি এখনও আসেনি। তারা না আসা পর্যন্ত অবশ্য স্বস্তি মিলবে না।
চকবৈদ্যনাথ আড়তে ৩২ জেলার চামড়া : নাটোর প্রতিনিধি জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাটোরের চকবৈদ্যনাথ চামড়া আড়তে এবারের কুরবানির ঈদের দিন বিকাল থেকেই কাঁচা চামড়া আসতে শুরু করেছে। নাটোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা আশা করছেন আগের মতোই এবার দেশের প্রায় ৩২টি জেলা থেকে ১০ লাখ গরু-ছাগলের চামড়া আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ঈদের দিন বিকালেই প্রায় ৭০ হাজার কাঁচা চামড়া জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে। শুক্রবার থেকে আসছে লবণ দেওয়া চামড়া। শুক্রবার প্রথম দিনেই প্রায় দেড় লাখ লবণযুক্ত চামড়া নাটোরের আড়তে এসেছে। প্রতি শুক্রবার এখানে মূল বেচাকেনা হয়। ঈদের মৌসুমে অন্য দিনেও এখানকার প্রায় দুইশ’ আড়তে কম-বেশি বেচাকেনা হয়। জেলার বড়াইগ্রামের কলেজ শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে লোডশেডিং হলেও এই চামড়া আড়তে এবার এক মিনিটও বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেনি। ফলে এবার কোনো চামড়া নষ্ট হয়নি।
রাজারহাট মোকাম জমজমাট : যশোর ব্যুরো জানায়, বরাবরের মতোই দাম নিয়ে হতাশ মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন না ব্যবসায়ীরা। হাট জমলেও বাইরের ব্যাপারী ও ট্যানারির লোক না আসায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হতে হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। তবে ব্যাপারীদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনছেন তারা। শনিবার এ মোকামে ৫০ হাজারের বেশি গবাদি পশুর চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এই হাটে খুলনা বিভাগের দশ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনাবেচা করতে আসেন। দাম নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থাকলেও বেচাকেনা ছিল জমজমাট। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হরেন দাস জানান, কুরবানিতে ৮শ থেকে ৯শ টাকার মধ্যে সাড়ে তিনশ পিস চামড়া কিনেছি। হাটে এসে সেই চামড়া ৭শ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারছি না। বাইরের পাইকার কম আসায় স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে জিম্মি হয়েই কম বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে যশোরের রাজারহাট চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন মুকুলের দাবি-বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত দামেই আজ রাজারহাট মোকামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।