১৮৭৩ সালের ৯ অক্টোবর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্ম কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের—এক ইহুদি পরিবারে। তবে নিজের ইহুদি পরিচয় তিনি লোকজনকে জানাতে পছন্দ করতেন না। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগমুহূর্তে একটা উইল করেছেন তিনি। তাতেও কঠিন এক শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। সেখানে স্ত্রীকে কড়াভাবে বলেছেন, তিনি যে জাতে ইহুদি, সেটা তাঁর সন্তানদের বয়স ১৪ বা ১৫ বছরের আগপর্যন্ত যেন জানানো না হয়। সেক্যুলার জীবনযাপন করতেন তিনি।
হাতে গোনা কয়েক দিন শোয়ার্জশিল্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আইনস্টাইনের। তখন দুজনের মধ্যে দু-একটা বাক্য বিনিময় হয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। অবশ্য এর পেছনে কিছু কারণও ছিল। একে তো শোয়ার্জশিল্ডের কর্মক্ষেত্র বার্লিন অবজারভেটরির অবস্থান পটসড্যামে। বার্লিন শহরের বাইরেই বলা যায় জায়গাটাকে। অন্যদিকে আইনস্টাইনের অফিস কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর ফিজিকস। সেটা শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে।
তাই দুজনের দেখা–সাক্ষাৎ হতো কদাচিৎ। তবে আইনস্টাইনের গবেষণা সম্পর্কে ঠিকই খোঁজখবর রাখতেন শোয়ার্জশিল্ড। একটা মহাকর্ষের তত্ত্বের পেছনে আইনস্টাইন যেভাবে প্রায় এক দশক ধরে ছুটেছেন, সে কথা তাঁর ভালোই জানা ছিল। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সঙ্গে মহাকর্ষকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে এত দীর্ঘ সময় খেটেছেন আইনস্টাইন।
দীর্ঘদিন খাটাখাটুনির পর অবশেষে ১৯১৫ সালের শেষ দিকে সঠিক সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব খুঁজে পান আইনস্টাইন। সে বছরের নভেম্বরে জার্মানির প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে মহাকর্ষের নতুন এই তত্ত্বের চারটি পেপার উপস্থাপন করেন তিনি। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের একটা নতুন আর অপ্রত্যাশিত কিছু চিত্র পাওয়া যেতে লাগল।
নিউটনের সূত্রমতে, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে মহাকর্ষ বল এমন থাকে, যেন অদৃশ্য কোনো দড়ি দিয়ে এই বস্তু দুটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ফলে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে চিরকালের জন্য বাঁধা পড়ে পৃথিবী। কিন্তু আইনস্টাইন নতুন তত্ত্বে বললেন, নিউটনের এই ধারণা আসলে ভুল। তিনি বললেন, সূর্যের মতো ভারী বস্তু আসলে তার চারপাশের স্থান-কাল বাঁকিয়ে দিয়ে উপত্যকার মতো তৈরি করে। আর উপত্যকার ঢালুতে গড়িয়ে চলতে বাধ্য হয় পৃথিবী। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সারমর্ম হলো: বস্তু স্থান-কালকে বলে কীভাবে বাঁকতে হবে আর বক্র স্থান-কাল বস্তুকে বলে কীভাবে চলতে হবে।
আইনস্টাইনের তত্ত্বমতে, বক্র স্থান-কালই হলো মহাকর্ষ। আবার স্থান-কাল চার মাত্রিক। কিন্তু ত্রিমাত্রিক জীব হওয়ার কারণে স্থান-কালের এই উপত্যকাকে আমরা বুঝতে পারি না। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো বস্তুর গতি ব্যাখ্যা করতে আমাদের তাই এতকাল মহাকর্ষের মতো একটা বল উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
আইনস্টাইন তত্ত্বটা ব্যবহার করেন, সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধের ধন্ধে ফেলে দেওয়া গতিপথ ব্যাখ্যায়। সৌরজগতে বুধের মতো গ্রহগুলো শুধু সূর্যের মহাকর্ষ দিয়েই নয়, অন্য গ্রহগুলো দিয়েও প্রভাবিত হয়। মহাকাশে এর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ক্রমান্বয়ে বদলে যাওয়া বা অয়নচলনের কারণ আসলে এই গ্রহগুলো। এই প্রভাব আমলে নেওয়ার পর বুধের কক্ষপথ বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়।
আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, বুধ গ্রহ সৌরজগতের সবচেয়ে ভারী বস্তু বা সূর্যের কাছাকাছি। এর মানে, গ্রহটির কক্ষপথ হবে যেকোনো গ্রহের চেয়ে সবচেয়ে বেশি বক্র স্থান-কালে। ফলে মহাকাশে তার গতিপথটাও প্রভাবিত হবে। আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্ব ব্যবহার করে অঙ্ক কষে বুধের গতিপথ অনুমান করলেন। এরপর জ্যোতির্বিদদের মাধ্যমে মিলিয়ে দেখলেন, এই অনুমান প্রায় পুরোপুরি মিলে গেছে। সেটা ছিল তত্ত্বটার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। কারণ, তত্ত্বটা বুধ গ্রহের খাপছাড়া গতি নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল।
রিম্যানের বক্র স্থানের জ্যামিতির কথা আগেই জানতেন শোয়ার্জশিল্ড। যুদ্ধক্ষেত্রে কানফাটা গুলির আওয়াজের মধ্যে মাঝেমধ্যে ভাবতেন, আইনস্টাইনের চেয়েও তিনি ওই সমীকরণগুলোর জন্য ভালো সমাধান বের করতে পারবেন কি না। আইনস্টাইনের সমীকরণ ব্যবহার করে সূর্যের মতো কোনো স্থানীয় ভরের চারপাশের স্থান-কালের সঠিক ফর্মুলা কি খুঁজে পাওয়া যাবে? ফল যা–ই আসুক, একবার চেষ্টা করে দেখার কথা ভাবলেন শোয়ার্জশিল্ড।
সে জন্য মৌলিক কিছু অনুমান সম্বল করে কাজে নামলেন তিনি। প্রথমত, সূর্য বা যেকোনো নক্ষত্র সুষমভাবে গোলীয়। দ্বিতীয়ত, তাদের চারপাশের স্থান-কাল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় না। তৃতীয়ত, স্থান-কালের বক্রতা দিকের ওপর নির্ভর করে না, বরং শুধু সূর্য থেকে ব্যাসার্ধীয় দূরত্বের (radial distance) ওপর নির্ভর করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই অন্তর্জ্ঞানের মাধ্যমে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো ব্যাপকভাবে সরলীকরণ করতে সক্ষম হন শোয়ার্জশিল্ড। এভাবে ১০টি সমীকরণ থেকে মাত্র একটাতে নামিয়ে আনা গেল। এরপর কিছু গাণিতিক ভেলকিবাজি প্রয়োগ করে দেখতে পান যে ওই একটিমাত্র সমীকরণের অনন্য একটা সমাধান রয়েছে।
এভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন শোয়ার্জশিল্ড। সূর্যের চারপাশের বক্র স্থান-কালে কোনো আসন্নতা নয়, বরং একটা নিখুঁত বর্ণনা খুঁজে পান। সেটাই ছিল আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রথম নিখুঁত কোনো সমাধান। এই সমাধান আবিষ্কারের মাধ্যমেই পদার্থবিজ্ঞানে শোয়ার্জশিল্ডের অমরত্বপ্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট ছিল।
সমাধানটা ব্যবহার করে শোয়ার্জশিল্ড বেশ দ্রুত বুধ–সংক্রান্ত আইনস্টাইনের দাবি নিশ্চিত করলেন। তিনি দেখালেন, বুধের অয়নচলন এই সমাধানের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। এই গাণিতিক হিসাব কাগজে লিখে ফেললেন তিনি। ১৯১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর একটা চিঠিসহ সেই গণনাটা পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনকে। চিঠির শেষে লিখলেন, ‘দেখতেই পাচ্ছেন, যুদ্ধটা আমার জন্য বেশ ফলদায়ক হয়েছে। তাই প্রচণ্ড গোলাগুলি সত্ত্বেও সবকিছু থেকে দূরে সরে আপনার ধারণার রাজ্যে পা ফেলার সুযোগ পাচ্ছি।’
আইনস্টাইন বুঝতে বাকি রইল না, মাত্র কদিনেই শোয়ার্জশিল্ড তত্ত্বটিতে শুধু দক্ষ হয়ে ওঠেননি, একে নতুন একটা রাজ্যে নিয়ে গেছেন। এই চিঠিই তার প্রমাণ। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম সঠিক সমাধান করেছেন ওই লোকটাই। অথচ কাজটাকে নিজের কাছে ভীষণ কঠিন ও অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ আইনস্টাইন। পরম আনন্দে শোয়ার্জশিল্ডকে চিঠির জবাব লিখতে বসলেন তিনি। লিখলেন, ‘পরম আগ্রহ নিয়ে আমি আপনার লেখা পেপারটা পড়েছি। ধারণাই করতে পারিনি, এত সরল উপায়ে এ সমস্যার সমাধান কেউ কখনো করতে পারবে। এ বিষয়ে আপনার গাণিতিক প্রয়োগ খুব পছন্দ হয়েছে।’
পরের বৃহস্পতিবার প্রুশিয়ান একাডেমিতে শোয়ার্জশিল্ডের কাজটা উপস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন চিঠিতে। কথামতো ১৯১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি শোয়ার্জশিল্ডের পেপারের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করলেন আইনস্টাইন।
তখনো পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে হাসপাতালে শুয়ে দুরারোগ্য অসুখে অনিশ্চিত দিন কাটাচ্ছেন শোয়ার্জশিল্ড। আইনস্টাইনকে প্রথম যে পেপারটা পাঠিয়েছেন, সেটাকে বলা যায় প্রথম অংশ। এ বিষয়ে কাজ আসলে তখনো অনেকটা বাকি। প্রথম পেপারে তত্ত্বটা ব্যবহার করে তিনি একটা আদর্শ নক্ষত্র বা গোলীয় ভরসংক্রান্ত গণনা করেন। তাতে ওই নক্ষত্রের চারপাশের বক্র স্থান-কালের সঠিক ব্যাখ্যা পান। কিন্তু নক্ষত্রটার ভেতরে কী ঘটছে? সেটা জানা তখনো বাকি ছিল। হাসপাতালে শুয়ে নিদারুণ কষ্ট সয়ে সে গণনা করছিলেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এ–সংক্রান্ত গণনা নিয়ে যখন ব্যস্ত থাকেন, তখন তাঁর দেহের ব্যথা কোথায় যেন উবে যায়। বাস্তবতা থেকে হারিয়ে কোনো এক স্বপ্নলোকে বুঁদ হয়ে যান। রুটিনমাফিক নার্সরা এসে ডাকেন, ‘প্রফেসর শোয়ার্জশিল্ড! আপনাকে ড্রেসিং করতে হবে…বিছানার চাদর বদলাতে হবে…আপনার একটু হাঁটা দরকার…।’ আবারও বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরেন বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। যে যুদ্ধ একই সঙ্গে তাঁর মাতৃভূমি রক্ষার এবং নিজ দেহের দুরারোগ্য অসুখের সঙ্গেও।
একসময় চমকপ্রদ সমাধান হাজির হলো তাঁর হিসাবে। সেখানে এমন একটা বিষয় খুঁজে পেলেন, যা এককথায় অবিশ্বাস্য। মহাকাশের কোনো বস্তু যদি একটা নির্দিষ্ট ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে সংকুচিত করে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে স্থান-কাল এত বেশি বেঁকে যাবে যে সেটা আর নিছক উপত্যকার চেহারায় থাকে না। তার বদলে সেটা হয়ে যায় একটা গর্তের মতো। সেটাকে বলা যায় মহাকাশের তলাবিহীন কুয়া। এই কুয়ার মধ্যে কিছু পড়লে তা আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এমনকি কোনো আলোও নয়। ওই নক্ষত্র তখন চিরকালের জন্য গোটা মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেটা মহাকাশের ভেতর একটা গর্তের মতো আবির্ভূত হয়। ওই অদ্ভুত বস্তুর নাম কী হতে পারে?
না, কোনো নাম দেননি শোয়ার্জশিল্ড। তবে এককালে বিশ্বের প্রায় কারও এই বস্তুর নাম জানতে বাকি থাকবে না। বস্তুটির নাম দেওয়া হবে ব্ল্যাকহোল। বাংলায় বলা হবে কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর। গোটা বিশ্বে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী—সবাইকে কৌতূহলের মধ্যে ফেলে দেবে মহাকাশের অদ্ভুতুড়ে বস্তুটি।
এই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধটা অবিশ্বাস্য রকমভাবে ছোট। স্থান-কালের সমাধান শোয়ার্জশিল্ড যেমনটা দেখিয়েছিলেন ঠিক তেমন। একদিন এই ব্যাসার্ধকে ডাকা হবে এর আবিষ্কারের নামে। শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস বা শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ। যেমন সূর্যকে যদি শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে সংকুচিত করা হয়, তাহলে তা ৩ কিলোমিটারে দাঁড়াবে। আর পৃথিবীর আকৃতি হবে মাত্র ১ সেন্টিমিটার। সূর্য বা পৃথিবীকে যদি কখনো এই আকৃতিতে সংকুচিত করে ফেলা হয়, তাহলে চোখের নিমেষে তারা চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে।
কয়েক দিন পরে শোয়ার্জশিল্ডের দ্বিতীয় পেপারটি এসে পৌঁছাল আইনস্টাইনের হাতে। এবারের গণনা দেখেও আগের মতোই বিস্মিত হলেন তিনি। ব্ল্যাকহোলের মতো একটা বস্তুর অস্তিত্ব দেখে ভীষণ চমকে উঠলেন তিনি, কিন্তু বস্তুটির অস্তিত্ব কিছুতেই মানতে পারলেন না। তবু ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে শোয়ার্জশিল্ডের দ্বিতীয় পেপারটা উপস্থাপন করলেন আইনস্টাইন। মহাকাশের অদ্ভুতুড়ে একটা বস্তুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সেই প্রথমবার জানতে পারল বিজ্ঞানী সমাজ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।