ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন : তালাকের পর দেনমোহর কী দিতেই হবে? এটা একটি কমন প্রশ্ন। দেনমোহর বিবাহিত মুসলিম নারীর একটি বিশেষ অধিকার। মুসলিম আইন অনুযায়ী, দেনমোহর হলো বিয়ের একটি শর্ত এবং স্ত্রীর একটি আইনগত অধিকার। এই অধিকার বলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী হয়। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ স্বরূপ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। বিবাহের সময় প্রতিদানস্বরূপ বর কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত অথবা গৃহীত কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে মোহর বলে। বিবাহের সময়ে বা পূর্বে এই দেনমোহর স্থির হয়। অবশ্য পরেও করা যেতে পারে।
দেনমোহর বা মোহরানা হলো কিছু টাকা বা কিছু সম্পত্তি, যা বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী।। ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, মোহর আদায় প্রতিটি স্বামীর জন্য ফরজ। দেনমোহর স্বামীর জন্য একটি ঋণ, সর্বাবস্থায় দেনমোহর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। লাহোর ও এলাহাবাদ হাইকোর্ট দেনমোহরকে স্ত্রীর মর্যাদাস্বরূপ বলে বিচার করেছেন – অর্থাৎ এটি হল আইনগত স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা। বিবাহ-চুক্তিতে যদি লেখাও থাকে দেনমোহর দিতে হবে না – সেক্ষেত্রেও দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য। অপরদিকে কলকাতা হাইকোর্টের মতে, দেনমোহর হলো সম্পত্তির মূল্য। মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রী এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসাবে স্বামীর উপর আরোপিত একটি দায়িত্ব মাত্র। দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য।
দেনমোহরের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? দেনমোহরের পরিমাণ সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়নি। তাই তা আপেক্ষিক। সাধারণত দেখা যায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। বিষয়গুলো হলো– স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থা ও বংশ মর্যাদা, স্ত্রীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা, স্ত্রীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং স্ত্রীর পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের (যেমন ফুফু, খালা, বোন) দেনমোহরের পরিমাণ। অপর দিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার বিবেচনা করেই মূলত দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না। তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন।
১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী দেনমোহর দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাওয়ামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত থাকলেও এর কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত নেই। তবে সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হল বিয়ের দিন নির্ধারণ করার পূর্বে উভয় পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে ধার্য করা। বর নিজেই এ চুক্তি করতে পারে। এই দেনমোহর দাম্পত্য মিলন, তালাক-বিচ্ছেদ অথবা স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুর দ্বারা নিশ্চিত হয়। দেনমোহরের বাবদ দেওয়া অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। “তাৎক্ষণিক” যাহা চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য এবং অপরটি “বিলম্বিত” দেনমোহর-যাহা মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ পরিশোধযোগ্য। মানে হলো বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও স্ত্রী দেনমোহর পাবেন। তালাকের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
স্ত্রী কি তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগে দেনমোহর দাবি করতে পারে? তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগেই স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে পারেন এবং স্বামী তখন নির্ধারিত দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ, তাই যে কোনো সময় স্ত্রী তা দাবি করতে পারে। স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের পরিমাণ অর্ধেক হইবে। কিন্তু দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহরে প্রদান করিতে হইবে।
স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী কীভাবে দেনমোহর আদায় করবে? মৃত মুসলমানের উত্তরাধিকারীগণ দেনমোহর ঋণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নহে। মুসলিম আইনে ৪৩ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুর নিকট প্রাপ্য অনগদ ঋণের ন্যায়-দেনমোহর ঋণের উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর সম্পত্তিতে প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী দায়ী হবে। সুতরাং বিধবা স্ত্রী দেনমোহরের দাবিকে তার স্বামীর সম্পত্তির দখলে থাকলে তার স্বামীর অন্যান্য উত্তরাধিকারীগণ সম্পত্তিতে নিজ নিজ প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে দেনমোহর ঋণ পরিশোধ করার পর পৃথক ভাবে স্ব স্ব অংশ উদ্ধার করতে পারবে। যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
টানা ২৫ দিন আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সাহস কে জোগাচ্ছেটানা ২৫ দিন আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সাহস কে জোগাচ্ছে
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এই আইনের ধারা ১০ এ মোহরানা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বিবাহের কাবিননামায় কি ধরনের দেনমোহর স্ত্রীর পাওনা হবে, তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা না থাকলে দেনমোহরের পুরো অর্থ স্ত্রী চাওয়ামাত্রই পরিশোধযোগ্য। সালিশী পরিষদের আদেশ বলে এটি কার্যকর হলে স্ত্রীর তা পাওনা হয়ে যায়। পরিশোধ না করলে ১ মাস কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর কার ট্রমা বেশি হয়—পুরুষ নাকি নারীর? বিবাহ বিচ্ছেদের পর কার ট্রমা বেশি হয়—পুরুষ নাকি নারীর?
স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী সমুদয় অথবা শুধুমাত্র বিলম্বিত দেনমোহরের অর্থ অনাদায়ি থেকে থাকে। তবে স্ত্রী তার প্রয়াত স্বামীর ভূসম্পত্তি দখল করত উহার রাজস্ব বা মুনাফা হতে তা উসুল করতে পারে। মুসলিম আইনে ৩০৩ ধারায় বিধবা দেনমোহরের দাবিতে স্বামীর সম্পত্তিতে দখলভোগী থাকা কালীন অন্যায়ভাবে উহা বেদখল হলে দখল উদ্ধারের জন্য মামলা অবশ্যই ছয় মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে (১৯০৮ সালের তামাদি আইন, তফসিল-১ অনুচ্ছেদ-৩) অনুযায়ী।
উল্লেখ্য, যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা ঐ দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। ফলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা দেনমোহর পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে পারবেন। কেননা ইসলামি আইনে দেনমোহরকে দেনা বলে বিবেচনা করা হয়।
দেনমোহরের পরিমাণ যত বেশি হোক না কেন, স্বামী তা সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এমনকি স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত দেনমোহরানার দায় হতে স্বামীকে মুক্তি দেবে না।
লেখক: অ্যাডভোকেট,বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।