জুমবাংলা ডেস্ক : বেশ কিছুদিন নীরব থাকার পর আচমকা বাংলাদেশ ও ভারতে আলোচনা শুরু হয়েছে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে। এ অবস্থায় দুই দেশের পর্যবেক্ষকরা গভীর আগ্রহ নিয়ে নজর রাখছেন- তিস্তা নিয়ে কী হচ্ছে? বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এই ইস্যুকে আলোচনায় নিয়ে আসায় অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বিষয়টিকে। তবে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বিষয়টি কি শুধুই তিস্তার পানি ভাগাভাগি এবং তিস্তা পাড়ের উন্নয়ন- নাকি এর পেছনে শক্তিধর দেশগুলোর লড়াইও জড়িয়ে আছে? তবে এটা ঠিক, বছরখানেক আগে থেকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত ও চীনের লড়াই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ চীনের অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছিল। কিন্তু ‘চিকেন নেকে’র নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে- এমন আশঙ্কার কথা বলে সেখানে কাজে আপত্তি দেয় ভারত। এরপর থেকে কাজই শুরু হয়নি। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তিও হচ্ছে না।
এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ, গত বুধবার রংপুরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার এবং গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র সেহেলি সাবরিনের মন্তব্য তিস্তা ইস্যুতে আশার সঞ্চার হয়েছে। পৃথকভাবে করা এমন তিনটি অগ্রগতির বিশ্লেষণ করে নদীটিকে নিয়ে নড়াচড়ার ইঙ্গিত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এর ফল কী হবে, তা কেউ বলতে পারছে না। এদিকে চলতি মাসের ২৩ ও ২৪ আগস্ট নয়াদিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হবে। দুদিনব্যাপী ওই বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি, গঙ্গা চুক্তির নবীকরণ, ৬ নদীর পানি ভাগাভাগি এবং সীমান্তে থাকা নদীগুলোর ভাঙন নিয়ে আলোচনা করতে চাইবে। আগামী ২২ আগস্ট বাংলাদেশের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল দিল্লি যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটি এমন সময় আলোচনায় এসেছে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর সমাগত। বাংলাদেশে ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটিই শেষ নয়াদিল্লি সফর। সেই সফরটি দ্বিপক্ষীয় না হলেও বাংলাদেশ-ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আলোচনায় তিস্তা স্থান করে নিতে পারে। এতে তিস্তা পাড়ের মানুষের লাভ হবে। পাশাপাশি পানি কূটনীতিতে সাফল্য পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, জি-২০ সামিটে যোগ দিতে আগামী সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে নয়াদিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ সচিব নাজমুল আহসান গতকাল বলেন, তিন্তা নিয়ে আমরা সবেমাত্র স্টাডি শেষ করেছি। আরো কয়েকদিন না গেলে এটি নিয়ে কী হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না। যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন গত রাতে বলেন, আগামী ২৩ ও ২৪ আগস্টের টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে আমরা তিস্তাসহ সব বিষয়ে দিল্লির মতামত জানতে চাইব।
এদিকে রংপুর সফরে গিয়ে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও শেষ মুহূর্তে চুক্তি হয়নি। অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেও নানা কারণে এর পথ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে রংপুর সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বললেন। দীর্ঘদিন আগের এই পরিকল্পনায় আসলে কী আছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২৪০ বছরের পুরনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
চীনের হোয়াংহো নদীকে একসময় বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতি বছর ওই নদীর পানি ভাসিয়ে দিতো শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম-পথ-ঘাট জনপদ। সেই সর্বনাশা নদীশাসন করায় (পরিকল্পিত ড্রেজিং) চীনের মানুষের দুঃখ ঘুচেছে। হোয়াংহো এখন হয়ে গেছে চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। হোয়াংহোর মতোই এখন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে।
চীনের প্রস্তাবিত এই ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে আছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে চীনের তৈরি প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুপাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। চায়না পাওয়ার কোম্পানি ইতোমধ্যে তিস্তাপাড়ে নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। তিস্তা নদীর পাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছেন।
পানি সংকটে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কৃষক। পানির অভাবে ফসলের ক্ষেত ফেটে হয় চৌচির। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলের তোপের মুখে ভারত তার ব্যারাজগুলোর মুখ খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতি বছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতি প্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চীনের এ আগ্রহে হঠাৎ নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী। এ নিয়ে এখন সরগরম হয়ে উঠেছে রংপুরের রাজনীতি।
গত ২০১৭ সালে ভারি বর্ষণ ও উজানের পানিতে গঙ্গাচড়া উপজেলার এসকেএসের বাজার, পূর্ব ইচলী ও সিরাজুল মার্কেটের পাশ দিয়ে তিস্তা নদীর নতুন প্রবাহ তৈরি হয়। ওই বছর রেকর্ড পরিমাণ বন্যায় তিস্তার চর ও দ্বীপচর থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্পিডবোটে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে কুড়িগ্রাম, রংপুরসহ অন্যান্য জেলার বন্যা পর্যবেক্ষণ করে সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। তিস্তা খনন না হওয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছর পলি পড়ছে। এতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে নতুন নতুন চর।
পরবর্তী সময়ে বর্ষায় পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন নতুন দিক থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, অবকাঠামো নদীতে চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে তিস্তার বাম তীরে থাকা অধিবাসীরা তিস্তার কবল থেকে রক্ষা পেতে বাঁধের দাবি করে আসছেন। ইতোমধ্যে তিস্তাপাড়ের এসব এলাকা পরিদর্শন করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিস্তাপাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলাসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি এসেছেন বলে সেই সময় চীনা রাষ্ট্রদূত জানিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের ইতিবাচক সাড়ার কথা ব্যক্ত করেন বলে জানা গেছে।
এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের মানুষকে তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চান শেখ হাসিনা সরকার। ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদীপাড়ের দুইধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানিয়েছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সমগ্র উত্তরবঙ্গকে অর্থনৈতিকভাবে ঢেলে সাজাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।