আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে নরেন্দ্র মোদির ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র পানি বিক্রি করতে চাইছে মমতার এই অভিযোগকে ‘মিথ্যা দাবি’ বলে আখ্যায়িত করেছে কেন্দ্র।
দ্বিপাক্ষিক সফর শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যাওয়ার পরই সোমবার (২৪ জুন) ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠিও পাঠান তিনি। তার অভিযোগ ছিল, রাজ্যের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশে পানি বিক্রি করতে চাইছে। এমনকি হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেন, কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। মমতার এমন বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টা না যেতেই মঙ্গলবার মমতার এই দাবিকে সম্পূর্ণ বাতিল করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রের খবর, ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখেছিল কেন্দ্র। তাতে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নবায়ন বিষয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত কমিটিতে রাজ্যের তরফ থেকে মনোনীত প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল। ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কমিটির জন্য রাজ্যের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে (নকশা ও গবেষণা) মনোনীত করা হয়। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল, রাজ্য সরকারের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চিঠি দিয়ে ফারাক্কা ব্যারাজের ভাটির অংশ থেকে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য তাদের মোট পানির চাহিদার বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএনআইও জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিথ্যা দাবি ছড়িয়েছে যে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি।
মঙ্গলবার দিনভর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং কেন্দ্রীয় প্রচারমাধ্যমে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা ও গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পর্কে রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে দেয়ার দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করা হচ্ছে তখন ফের ময়দানে নামেন মমতা। নিজে প্রকাশ্যে না এলেও সচিবালয় নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার হয়ে রাজ্যের এই সিনিয়র আমলা দাবি করেন রাজ্য, দেশ ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লিখিত জানিয়েছেন।
আলাপন বলেন, গতকাল ২৪ জুন লেখা চিঠির আগে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর, ওই বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারি এবং তারও আগে ২০১৭ সালের ২৫ মে চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সবক’টি চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ পানিবণ্টন বহু বছরের একটি বিষয়। যার উপরে নির্ভর করে কোটি কোটি মানুষের পানি পাওয়ার ইস্যু। এর ওপর নির্ভর গঙ্গার ভাঙনজনিত সমস্যাবলি। এ ছাড়া এর ওপর নির্ভর করে আমাদের কৃষি, সেচ, পানীয় জল প্রভূত বিষয়।
কেন্দ্র যে বিষয়টিকে বাংলাকে অবগত রেখে করা হয়েছে বলে দাবি করছে সেটি হল ২৪ জুলাই ২০২৩ সালে জলশক্তি মন্ত্রক একটি ১২ সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে। তাতে একজন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে রাখা হয়েছিল বলে আলাপন দাবি করেন।
এরপর ১৪ জুন, ২০২৪ সেই কমিটি কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে তাদের রিপোর্ট দেয়, যা জলশক্তি মন্ত্রকে জমা পড়ে। তাদের দাবি, রাজ্য সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মত দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে দু-একটি ছোট ইনপুট ছাড়া আর কিছু চাওয়া হয়নি বলে দাবি জানান মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা।
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক লেখা চিঠিতে যেভাবে উত্তর ও মধ্যবঙ্গ থেকে যেসব নদী বাংলাদেশে যায়, এবং নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত গুচ্ছ সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা এই রিপোর্টে বিন্দুবিসর্গ নেই বলে জানান আলাপন। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো জলশক্তি মন্ত্রক এই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোনো চিঠি দেয়নি। কোনো যোগাযোগ করেনি। কোনও আলোচনাও করেনি।
আলাপন আরও বলেন, মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পানিবণ্টন নিয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন সেসবের কিছুই জলশক্তি মন্ত্রকের নজরে ছিল না। তারা সে সম্পর্কে রাজ্য সরকারকে কোনও কিছুই জানায়নি। শেষে তিনি বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্যে নীতি-নির্ধারক কোনও কমিটিতেই ভারত-বাংলাদেশ পানিচুক্তি নিয়ে কোনও কথা বা আলোচনা হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন ২০২৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তার নবয়ানের জন্য উভয় দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবেন। একইসঙ্গে তিনি এটাও জানান, তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার ব্যাপারে ভারতের একটি কারিগরি দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা কিংবা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন মমতা। তার বক্তব্য, ফারাক্কা চুক্তির কারণে আমরা ১৯৯৬ সাল থেকে কষ্ট ভোগ করছি। বাংলার পানি বিক্রি করে দেওয়ার অর্থ হলো, আগামী দিনে গঙ্গার ভাঙন বাড়বে, মানুষের ঘরবাড়ি পানির তলায় তলিয়ে যাবে। ফারাক্কায় ড্রেজিং না করার ফলে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা কমে গেছে, টান পড়েছে লাখ লাখ মানুষের জীবিকায়। আবার তিস্তার পানি নিয়ে তার অভিমত, তিস্তায় পানি নেই। সেখান থেকে পানি দিলে উত্তরবঙ্গের একাংশের মানুষ আগামী দিনে খাবার পানি পাবে না, বিশাল অংশের মানুষের কৃষি কাজে সমস্যা হবে। অর্থাৎ রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনোভাবেই পানি দেওয়া সম্ভব নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।