আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও উত্তেজনার ছায়া। বিশ্বযুদ্ধ শব্দটি যেন ফিরে এসেছে খবরের শিরোনামে, আর এইবার এর কেন্দ্রবিন্দুতে রাশিয়া। নিরাপত্তা পরিষদের সচিব সের্গেই শোইগুর সাম্প্রতিক বিবৃতি বিশ্বজুড়ে এক নতুন আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। রাশিয়ার মতে, ইউক্রেনে তথাকথিত ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েন হলে তা সরাসরি ন্যাটো ও রাশিয়ার সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইতিহাসের আলোকে এটি শুধুই এক রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং এক গম্ভীর বার্তা।
বিশ্বযুদ্ধ সম্ভাবনা: রাশিয়ার সতর্কবার্তার পেছনের প্রেক্ষাপট
রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সচিব সের্গেই শোইগু সম্প্রতি রুশ সংবাদ সংস্থা তাস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ইউক্রেনে শান্তিরক্ষীর ছদ্মবেশে সামরিক শক্তি মোতায়েনের পরিকল্পনা করছেন। তার মতে, এই ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী মূলত সেই সব ন্যাটো দেশ থেকে আসবে যাদের ইউক্রেনে উপস্থিতির বিরোধিতা রাশিয়া বহু আগেই প্রকাশ্যে করেছে।
Table of Contents
তিনি আরও বলেন, ইউরোপের যুক্তিবান রাজনীতিকরাও বুঝতে পারছেন, এই ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা সরাসরি সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে এবং পরিস্থিতি এমন জটিল হয়ে উঠতে পারে যে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
এই বক্তব্য শুধু সামরিক হুমকি নয়; এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া একটি বার্তা দিতে চায় যে তারা ইউক্রেন ইস্যুতে কোনওরকম ‘আধা-সামরিক’ বা ‘শান্তিরক্ষী’ উপস্থিতি মেনে নেবে না। এটি রাশিয়ার ভূখণ্ড ও স্বার্থের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘শান্তিরক্ষী’ না ‘দখলদার’? ইউক্রেন সংকটে লুকানো লক্ষ্য
শোইগুর মতে, এই তথাকথিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর লক্ষ্য মূলত ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। শোইগু একে স্পষ্টভাবে দখলদারি হিসেবে আখ্যা দেন।
রুশ নিরাপত্তা পরিষদের মতে, ইউক্রেনে এই ধরনের বাহিনী মোতায়েন করা হলে তারা স্থানীয় জনগণের সাংস্কৃতিক অধিকার, ভাষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানতে পারে। বিশেষ করে রুশ ভাষাভাষী জনগণ ও রুশ অর্থডক্স খ্রিস্টানদের ওপর নিপীড়নের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শোইগু।
তিনি আরও বলেন, এটি শান্তিরক্ষা মিশনের অন্তর্গত নয় বরং এক বিশেষ ধরনের সামরিক দখলদারি যার পেছনে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল জলরাশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পশ্চিমা জোটের মনোভাব
ইউরোপীয় জোটের একাংশ এখনও ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ফ্রান্স, জার্মানি, এমনকি ন্যাটো সদস্যরাও এই পদক্ষেপের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা কেবল রাশিয়া নয়, পুরো ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ কারণে বহু দেশ এখনও দ্বিধায় ভুগছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
এই হুঁশিয়ারির প্রেক্ষিতে চীন, ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ রাশিয়ার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা মনে করছে, ইউক্রেন সংকট সমাধানে শান্তিপূর্ণ সংলাপই একমাত্র উপায়। শান্তিরক্ষী পাঠানো মানে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাওয়া।
এদিকে জাতিসংঘও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সংস্থাটির মতে, ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক ঐকমত্য প্রয়োজন এবং তা নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি: বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ
বিশ্ব ইতিহাসে দুটি বিশ্বযুদ্ধ যে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল, তা আজও মানুষের মনে তাজা। তাই নতুন করে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা কল্পনাও বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। বর্তমান বৈশ্বিক সংযুক্ত অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে একটি বিশ্বযুদ্ধ হলে তার পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।
বিশ্বযুদ্ধ মানেই শুধু সামরিক সংঘর্ষ নয়; এর প্রভাব পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি সরবরাহ, পরিবেশ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর। বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থান সংকট, এবং মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, তাহলে তা শুধু ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকেও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করবে।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে, একটি নতুন বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। জ্বালানি, খাদ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা এ অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে তেল ও গ্যাসের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, খাদ্য আমদানির জটিলতা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে বিঘ্ন বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে এক গভীর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে। এমনকি এই পরিস্থিতিতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে কড়া নজর রাখা ও কূটনৈতিক কৌশলে ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
FAQs
বিশ্বযুদ্ধ কী?
বিশ্বযুদ্ধ একটি বৈশ্বিক সামরিক সংঘাত যেখানে বিশ্বের বড় একটি অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত বহু দেশ, মহাদেশ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন আলোচনায়?
রাশিয়ার সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারির ফলে ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। সামরিক শক্তি মোতায়েন, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক অবস্থান এতে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব কী হতে পারে?
বিশ্বযুদ্ধের ফলে জ্বালানি সংকট, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। এটি শুধু যুদ্ধে জড়িত দেশ নয় বরং পুরো পৃথিবীকেই প্রভাবিত করে।
রাশিয়া কী শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিরোধিতা করছে?
হ্যাঁ, রাশিয়া মনে করে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী মোতায়েন হলে তা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে এবং এটি ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
বাংলাদেশে এ পরিস্থিতির প্রভাব কী হতে পারে?
বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট, খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়তে পারে। এটি দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।