মো. রাকিবুল ইসলাম : বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাক শিল্প হলো সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এবং সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টকারী খাত। বর্তমানে রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে এবং ৮১ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ হয় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। যাত্রা শুরুর পর থেকেই নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এ খাতকে। দীর্ঘদিন ধরেই এ শিল্পকে ঘিরে চলছে বিশৃঙ্খলা। তৈরি হয়েছে নানা অস্থিরতা। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের সময়মতো বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করা।
এছাড়া পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি, ভবন ও অগ্নি দুর্ঘটনার প্রকোপ, শ্রমিকদের প্রতি ব্যবসায়ী-মালিকদের অপেশাদার আচরণ, নকল ও নিম্নমানের পোশাক রফতানি, নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, কাঁচামাল আমদানি জটিলতা, অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমিক ছাঁটাই ইত্যাদি তৈরি পোশাক শিল্প খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী এ রফতানি খাতটি যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছে
সেটা হলো অর্ডার বাতিল হওয়া। বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো যেটাকে নকল পণ্য রফতানি হিসেবে অবহিত
করছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে নকল তৈরি পোশাক রফতানি এর আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এটা নিয়ে উদ্বেগও জানানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। বিষয়টি পোশাক খাতের জন্য যে মোটেই সুখকর নয়। পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন। তারই ধারাবাহিকতায় তাজরীন গার্মেন্টস, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, দেশে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানায় গত কয়েক বছরে অগ্নি দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২০ সালে ১৭৭টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ২০২২ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ২৪১টি। অন্যদিকে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা এখনো শূন্যে নামেনি। ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন আর গত বছর মারা গেছেন চারজন পোশাক শ্রমিক। এছাড়া দেশের মোট পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে বর্তমানে ৮৫৬টি কারখানা রয়েছে যেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। কোনো রকম তদারকি ছাড়াই তারা উৎপাদন ও রফতানি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন এরকম কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মোট কারখানার ২২-২৩ শতাংশ তদারকির বাইরে। সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এটা বেড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অথচ এ ব্যাপারে না আছে কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা না আছে সরকারের কঠোর নির্দেশনা ও পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করছেন ৩২ লাখ শ্রমিক। অথচ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে কোনো কারণ ছাড়াই বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাই যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পোশাক শ্রমিকের হাড়ভাঙা খাটুনি আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমে ব্যবসায়ী-মালিকরা মোটা অংকের মুনাফা ঘরে তুলছে। দেশের অর্থনীতিতে সুদিন ফিরে এসেছে। উন্নয়নের সবুজসংকেত দেখতে পাচ্ছে দেশ। অথচ নেপথ্যের কারিগররা ন্যায্য মজুরি আর বকেয়া বেতন-বোনাস ঠিকমতো পাচ্ছে না। যেকোনো উৎসব-পার্বণের সময় বেশির ভাগ পোশাক শ্রমিকদের রাজপথে নেমে আন্দোলন করতে হয় তাদের নিয়মিত বেতন-বোনাস আদায় করতে।
অনেক সময় কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের দিয়ে ওভারটাইম কাজ করালেও এর বিনিময়ে তাদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হয় না। এছাড়া নিম্ন মজুরি হার আর কম বেতন-ভাতার জন্য শ্রমিকদের অসন্তোষ তো আছেই। ন্যায্য মজুরি আর নিয়মিত বেতন-বোনাসের জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত হয়নি কোনো স্থায়ী সমাধান। বিলসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও অনেক কম।
ভারতে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৪ হাজার ৯৭৬ টাকা (১২৮ ডলার) আর বাংলাদেশে ৮ হাজার টাকা (৬৮ দশমিক ৩৮ ডলার, প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসেবে)। অথচ বাংলাদেশে যে হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এ মজুরি নিতান্তই অপ্রতুল। এত অল্প বেতনে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ মানুষগুলোকে।
আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী-মালিকরা অনেক সময় প্রণোদনা পেলেও
শ্রমিকদের মধ্যে হচ্ছে না তার যথাযথ বণ্টন। এ খাতে যে হারে বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জন বেড়েছে সে হারে শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ায় দিনে দিনে তাদের মধ্যকার অসন্তোষ বাড়ছে, যা এ খাতকে
অস্থিতিশীল করে তুলছে।
পোশাক খাতে মোট শ্রমিকের প্রায় ৫৮ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ পুরুষ। তৈরি পোশাক শিল্পে এ বিপুলসংখ্যক নারীর অবদান এ খাতকে এক অন্যান্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অথচ নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি, অনিয়মিত বেতন ভাতা, কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া, সময়মতো পদোন্নতি না পাওয়া, অপর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি সমস্যাগুলো যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সেলাই ও অপারেটরের কাজ ছাড়া বড় কোনো পদে তাদের পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। কিছু গার্মেন্টসে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলেও তা ছয় মাসের জায়গায় তিন মাস দেয়া হয়। এ অবস্থায় খাতটিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়েও দেখা গেছে ব্যাপক অসন্তোষ।
এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে লোকসানের মুখ দেখতে হচ্ছে এ খাতকে। কাঁচামাল আমদানিতেও প্রায়ই পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। আমদানি ব্যয় বেড়েছে, বিশেষ করে আমদানি পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এ শিল্প খাতটি। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় বিশ্ববাজারে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে এ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এ খাতের প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে এবং অর্থনীতিতে এর উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে হলে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক পদক্ষেপের সুপারিশ এখন মাত্র সময়ের দাবি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।