রঞ্জু খন্দকার, রংপুর: পানি যদিও হালকা নীল, তবে জায়গাটি দরিয়া অর্থাৎ সমুদ্র নয়। বরং খাল। তবু নাম- নীল দরিয়া।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের জলামহল এলাকায় এই নীল দরিয়ার অবস্থান।
গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, তিনদিক বেষ্টন করে আছে স্বচ্ছ পানি। ঘাটে নোঙর করা নৌকা।
নৌকার মাঝি রাজা মিয়া জানালেন, খালটির আয়তন ৩০০ বিঘা। পুরো খাল ঘুরতে তিনি লোকসংখ্যা ভেদে ২-৩ শ টাকা নেন। খালের একপ্রান্তে রয়েছে পদ্মবিল। সেখানে ঘুরতে গেলে গুনতে হবে ১০০ টাকা।
নৌকায় পদ্মবিলে গিয়ে দেখা গেল, রাশি রাশি ফুটে আছে সাদা পদ্ম। কিছু দর্শনার্থী সেখান থেকে ফুল তুলতে শুরু করলেন। তাতে মৃদু আপত্তি জানান মাঝি রাজা মিয়া।
রাজা মিয়া বললেন, বিলে আরও অনেক পদ্ম ছিল। কিন্তু অনেকেই পদ্ম তুলে নিয়ে যান। এ কারণে ফুল কমেছে। ফুলগুলো থাকলে সবাই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারত।
বিল থেকে ঘুরে এসে দেখা গেল, খালের মাঝখানে সবুজ সমতল। সেখানে লাগানো গাছপালা মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। রয়েছে নাগরদোলা, দোলনাসহ শিশুদের বিনোদনের নানা খেলনা। মাঝখানে একটি চায়ের দোকান।
চায়ের দোকানটির মালিক মো. হৃদয়। তিনি পাশের এলাকার বাসিন্দা।
হৃদয় জানালেন, নীল দরিয়া দেখতে দিনে শ খানেক মানুষ আসেন। ছুটির দিনগুলোতে দুইশ-আড়াইশ। সেদিন বেচাবিক্রি একটু বেশি হয়।
হৃদয় আরও বললেন, কিছুটা নির্জন হওয়ায় এখানে কিছু ব্যক্তি গাঁজা খেতে আসেন। এটা ভালো লাগে না। প্রশাসন একটু নজরদারি করলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
সমতল এলাকাটি ঘুরে হৃদয়ের দাবির সত্যতা পাওয়া গেল। ঘুরে আরও দেখা যায়, সমতলের চারদিকে উঁচু গড়। স্থানে স্থানে প্রাচীন স্থাপনার ধংসাবশেষ।
সরকারের তথ্য বাতায়ন বলছে, সেন বংশীয় রাজা নীলাম্বর সেনের স্মৃতিবিজরিত জায়গা এটি। নীলাম্বর তাঁর রাজ্য সুরক্ষিত করতে চারদিকে খাল কেটে পরিখা খনন করেন। তাঁর নামানুসারেই খালটিকে নীল দরিয়া বলা হয়।
স্থানীয় বর্ষীয়ান দুজন দাবি করলেন, মানুষের উচ্চতা যখন ২৮ হাত ছিল, সেই আমলের রাজা নীলাম্বর।
এই তথ্যের ভিত্তি কী–এমন প্রশ্নে দুই বর্ষীয়ান বললেন, এসব কোনো বইয়ের কথা নয়। বংশ পরম্পরায় এক মুখ থেকে আরেক মুখে ছড়িয়ে পড়া লোককাহিনী।
জনশ্রুতি রয়েছে, কুরাইশ বংশীয় পীর হযরত শাহ ইসমাইল গাজীর (রহ.) কাছে রাজা নীলাম্বর পরাজিত হন। এরপর এই এলাকায় সেনশাসনের অবসান ঘটে। এই গড়ে জীয়ন ও মরণ কুণ্ড, রানি ও রাজার ঘাট, নীল জলাশয়, পানধোয়া ঘাট, জলযোগের ঘাট, পাখির ঘাট, দরিয়ার পাড়, বরুজের গড়, চণ্ডীমণ্ডপ, নিশানঘাট, কামতা বা কালিমন্দির, শাহ ইসমাঈল গাজীর (রহ.) মাজার ইত্যাদির ধংসস্তূপ রয়েছে।
তথ্য বাতায়ন সূত্রে আরও জানা যায়, নীল দরিয়ার আয়তন ৯২ একর। এর মাঝখানের স্থলভাগ দুটি খণ্ডে বিভক্ত। খণ্ড দুটিকে বলা হয় যথাক্রমে প্রথম কোর্ট ও দ্বিতীয় কোর্ট । প্রথম কোর্টে ভূমির পরিমান ২৬ একর। দ্বিতীয় কোর্টে জমির পরিমাণ ২২ একর। প্রথম কোর্টে বর্তমানে জনবসতি তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় কোর্ট বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে আছে। জলাশয়টি বর্তমানে সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে। সেখানে মাছচাষ হচ্ছে।
ঘুরতে আসা কয়েকজন জানালেন, তাঁদের বাড়ি আশপাশের উপজেলায়। অনেকেই আগে জায়গাটি সম্পর্কে শুনলেও এতদিন আসেননি। আজ সুযোগ পেয়ে এসেছেন। অনেকে আগেও কয়েকবার এসেছেন।
তবে প্রত্যেকেই বললেন, জায়গাটি সম্পর্কে সরকারের তেমন প্রচার নেই। এই এলাকায় বিনোদনের চমৎকার একটি কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে নীল দরিয়া।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।