রশীদ জামীল: তিনি একটি দাওরায়ে হাদিস মাদরাসার হাদিসের উস্তাদ। সহিহ হাদিসের কিতাব মুসলিম শরিফ পড়ান। প্রতি বৃহস্পতিবার জোহরের পরে বাড়ি যান। শনিবার সকাল ১০টার আগে আবার ফিরে আসেন। এটা কোনো গল্প নয়, নিজের দেখা একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। আর বলে রাখি, তিনি আমার উস্তাদ ছিলেন, কিন্তু আমি সেই মাদরাসার ছাত্র ছিলাম না।
এক বৃহস্পতিবার জোহরের নামাজের পর তার রুমে গিয়ে দেখলাম বাম হাতের কনুইয়ের ভেতরের অংশ চোখের ওপর রেখে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। ভাবলাম, শরীর খারাপ হলো কি না! বললাম, হুজুর! শরীর খারাপ?
তিনি চোখের ওপর থেকে হাতটা সরালেন। বললেন, না।
বললাম, তাহলে বাড়ি যাবেন না? আজ তো বৃহস্পতিবার।
তিনি বললেন, মনে হয় আজ যাওয়া হবে না।
কিন্তু কেন?
বললেন, আজ মাসের ১১ তারিখ। বেতন দেওয়ার কথা ছিল। একটু আগে হিসাবরক্ষক জানিয়েছেন আজ বেতন হবে না। অথচ আমি জানি ফান্ডে টাকা আছে, অন্যদের দিয়েছেও। শুধু আমাকে দেয়নি। জেদ মেটাচ্ছে আমার সঙ্গে। সেদিন তার সঙ্গে একটু তর্ক হয়েছিল আমার। ব্যাটা আমাকে প্রতি সপ্তাহে একদিন বলে চিল্লায় যেতে বলে। আমি তখন, ‘দেখি, নিয়ত আছে’ ইত্যাদি বলে পাশ কাটাই। কিন্তু একই কথা বারবার বলতে থাকলে কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো? সেদিন যখন বলল, ‘আপনাকে কতদিন বললাম চিল্লায় যেতে। আমরা তাবলিগে আলেম পাচ্ছি না। আপনারা আলেমরা সময় দিতে চান না। তখন আমি বললাম, কিছুদিন থেকে আমিও তাই ভাবছি। কত টাকা হলে একটা চিল্লা দিয়ে আসা যাবে? সে বলল, টাকা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। টাকা আমি দেব, আর আপনার বেতনও ঠিক থাকবে। আমি বললাম, তাহলে তো আরও ভালো। এবার শুধু একটা কাজ বাকি। এই কাজটিও যদি করে ফেলেন, তাহলে আর কোনো চিন্তাই থাকল না।
তিনি বললেন, কী সেটা?
আমি বললাম, এই চল্লিশ দিন আমার মুসলিম শরিফটা আপনাকে পড়াতে হবে।
তিনি বললেন, এটা কী বললেন?
ঠিক তখনই মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘এই মিয়া! তাবলিগের কী বুঝেন আপনি? আমাকে হাদিসের দরস ফেলে চিল্লায় চলে যেতে বলেন, আপনার মতো মানুষের এক চিল্লা থেকে যে আমার ৪৫ মিনিটের হাদিসের দরস বড় তাবলিগের কাজ- এটা কি আপনার মাথায় ঢুকে না?
এর পর থেকে সে আমার ওপর ফুলে লাউ হয়ে আছে। আজ সবার বেতন দিয়েছে, শুধু আমারটা দেয় নাই। এদিকে আবার…
একটু থামলেন তিনি। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছেন না।
বললাম, এদিকে আবার কী? আরও কোনো সমস্যা?
বললেন, না, কিছু না।
বললাম, ছাত্র তো সন্তানের মতো। সন্তানের কাছে বাবাদের কিছু লুকাতে হয় না, কী হয়েছে বলেন?
শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। একটু বিব্রত, লজ্জা এবং কষ্ট মেশানো সুরে বললেন, ‘সকালে তোমার চাচী ফোন করে বলেছে চাল শেষ হয়ে গেছে। রাতের খাবার হবে, সকাল থেকে চাল লাগবে…
কথাগুলো তিনি বলছিলেন নিচের দিকে তাকিয়ে। চোখ দু’টো ছলছল করছিল। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমরা ছাত্র মানুষ, কীইবা করার থাকে? তবে হুজুর সেদিন বাড়ি যেতে পেরেছিলেন।
১৯৯৪-৯৫ সালে আমি আমার নিজের দেখা একটি ঘটনা শেয়ার করলাম। ঘুরে ফিরে অন্যভাবে ভিন্ন কারণে এমন অবস্থার মুখোমুখি আরও অনেক জায়গায় আরও অনেককেই হতে হয়। কেউ মুখ ফুটে বলেন না। বলেন না বলে আমরাও তাদের নিয়ে ভাবি না। দিনরাত পড়ে থাকেন কিতাব আর ছাত্র নিয়ে। আমাদের কি উচিত ছিল না তাদের কথা ভাবা? অন্তত তাদেরও যে একটা ফ্যামিলি আছে, তাদের ঘরেও যে ছোট ছোট বাচ্চা আছে, কথাটি মাথায় রাখা?
আমাদের উস্তাদরা ঠিকমতো বেতন পান না কয়েক কারণে। কিছু কারণ আবার খুবই অকারণ। এই যেমন এখানে একটা অকারণের কথা বলা হয়েছে। কিছু কিছু মাদরাসা আর্থিক সংকটের কারণে তার উস্তাদদের বেতন দিতে পারে না। এটা কিছু সময়ের জন্য মানা গেলেও যে ব্যাপারটি কোনোভাবেই মানা যায় না- সেটি হলো, ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও উস্তাদদের বেতন না দেওয়া। উপরন্তু যদি দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান প্রধান আয়েশি জীবন-যাপন ঠিকই করে যাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকদের বেতনের বেলায় অভাব আর অভাব।
এই যে এখন সারাবিশ্বে একটা ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে, সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনিতেই মাদরাসাগুলো শাবানের ১৫ তারিখের পর বন্ধ ঘোষণা করা হতো। কিন্তু এবার করোনার কারণে কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। পরিস্থিতির কারণে অনেকটা তড়িঘড়ি করে মাদরাসাগুলো বন্ধ দিতে হয়েছে। পরে আবার বন্ধের মেয়াদ বেড়েছে। আপাতত রমজানের আগে আর খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন কী হবে?
আমাদের মাদরাসাগুলোর একাডেমিক বছর শুরু হয় শাওয়াল থেকে, শেষ হয় শাবান মাসে। তারপর রমজানের জন্য একমাস বন্ধ হয়ভ এই সময়ে পুরো বছরের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার একটা ব্যাপার থাকে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বেতন পরিশোধ করে দেয়। যারা পারে না, তারা কিছু দেয় কিছু বাকি থাকে। এখন যে দুইমাস আগে মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেল, এই অবস্থায় বাংলাদেশের দুই লক্ষাধিক কওমি উস্তাদের কী হবে? যে প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাববার দরকার ছিল, এগুলো নিয়ে কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। যেমন-
১. তারা কি রজব এবং শাবান মাসের বেতন পাবেন?
২. যাদের কয়েক মাসের বেতন বাকি, তাদের কী অবস্থা?
৩. এ বিষয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কি কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে?
৪. মাদরাসাগুলোরও কি সেই সামর্থ্য আছে? যদি না থাকে, তাহলে তাদের কী করা উচিত?
৫. এ ব্যাপারে আমাদের বোর্ডগুলোর কি কোনো মাথাব্যথা আছে, কিংবা কোনো দিক-নির্দেশনা?
৬. এমন ঘোরতর দুর্দিনে এই দুই লক্ষাধিক উস্তাদ যদি তাদের বেতন না পান, তাহলে তাদের পরিবার চলবে কী দিয়ে?
সবচে বড় কথা হলো, এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার মতো অথরাইজড কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকা। আমাদের কওমি শিক্ষাবোর্ডগুলো ছাত্রদের কাছ থেকে ফি আদায় করা এবং বছরে একটি করে কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো কাজ আছে বলে তারা মনে করেন কি না- আমরা জানি না। তাহলে সবমিলিয়ে অবস্থাটা কী দাঁড়াল?
সমাধানের পথ কী?
চলুন ভাবি, সাধ্যেরটুকু নিজেরা করি।
বাকিটা পরামর্শ দেই যথাস্থানে, যথাযথ বিনয়ের সঙ্গে।
রশীদ জামীল: কলাম লেখক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।