রহস্যের জট খোলা গোয়েন্দাদের কাজ। নিবিড় পর্যবেক্ষণ, যুক্তি ও বুদ্ধি খাটিয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে রহস্যের জট খোলেন। বিজ্ঞানীদের কাজটাও অনেকটা সেরকম। গোয়েন্দা গল্পের শেষে যেমন সব রহস্য পাঠকদের সামনে মেলে ধরা হয়, তেমনি বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক নানা রহস্য ভেদ করে সমাধান খুলে ধরেন। তাতে ব্যাখ্যা মেলে রহস্যময় মহাবিশ্বের অদ্ভুত নানা কাজকর্মের। একটু থেমে ভাবুন তো, এরকম কজন বিজ্ঞানীর রহস্যভেদের গল্প আমরা জানি?
আলোচ্য বইটি সেরকম কিছু গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে। এই কাহিনিগুলোর নায়কের (ও নায়িকার) চরিত্রে রয়েছেন আইজ্যাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মাইকেল ফ্যারাডে, মেরি কুরি, কার্ল শোয়ার্জশিল্ড, হেনরি বেকেরেল, উলমহেম রন্টজেনদের মতো রথী-মহারথীরা।
তাঁদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে চলে এসেছে আরও অনেক বিখ্যাত বা সচরাচর অচেনা বিজ্ঞানীর কথা। পাশাপাশি এমন সাতটি আবিষ্কার নিয়ে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে আমরা কিছুটা জানি, কিন্তু সম্পূর্ণটা জানি না অনেকেই। ধরুন নিউটন এক টুকরা কাগজে আঁকিবুঁকি করে মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেছেন, এটা মোটামুটি আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা জানি কতজন? এরকম কিছু গল্প নিয়েই আবুল বাসারের আবিষ্কারের কাহিনি।
বইয়ে মোট ৭টি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কুরি দম্পতির কারিকুরি’। মেরি কুরি নামটার সঙ্গে প্রায় সবাই পরিচিত। তাঁর স্বামী পিয়ের কুরিকেও জানেন অনেকে। কিন্তু এই অধ্যায়ে শুধু তাঁদের কথাই বলেননি লেখক। শুরুতেই একটা অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
ওয়াকিমাথাল। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই আসে এই শহরে। কারণ, সেখানে একটা খনি আছে। এখন যে ‘ডলার’ নামে মুদ্রা প্রচলিত আছে, তা এসেছে এই শহরের নাম থেকে। সেখানে পাওয়া যেত পিচব্লেন্ড নামে একধরনের খনিজ। সেই খনিজের সঙ্গে একে একে জুড়ে যাবেন হেনরি বেকেরেল, উইলহেম রন্টজেনসহ আরও অনেক বিজ্ঞানী। এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ইতিহাসের প্রথম নোবেল পাবেন রন্টজেন।
আবিষ্কার হবে তেজস্ক্রিয়তা। এই তেজস্ক্রিয়তা নামের … নিয়ে দিন রাত পরিশ্রম করবেন কুরি দম্পতি। তাঁদের আবিষ্কৃত রেডিয়াম বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগবে। তবে এর অযাচিত, অনর্থক ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক মানুষ নিজের অজান্তেই ঝাঁপ দেবেন মৃত্যুর মুখে। এই সবকিছু জানা যাবে বইটির প্রথম অধ্যায়ে।
‘কৃষ্ণগহ্বর: মহাকাশের তলাবিহীন কুয়ো’ বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়। একজন ইহুদী নিজের দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে যোগ দেন যুদ্ধে। কিছুদিন কাজ করার পর যুদ্ধের ময়দান থেকে তাঁর জায়গা হয় হাসপাতালের বিছানায়। একা একা শুয়ে-বসে থাকেন। নিজেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে সারাদিন মাথার মধ্যে কী সব গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করেন। মাঝেমধ্যে বসেন খাতাকলম নিয়ে। ঘুম আর বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা আসলে ঘটছে, তা বুঝতেও পারেন না। এভাবে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আবিষ্কার করে বসেন কৃষ্ণগহ্বর! নিজের আবিষ্কার দেখে নিজেই অবাক হন। চিঠি লেখেন আলবার্ট আইনস্টাইনকে। খোদ আইনস্টাইনও অবাক হলেন। যার কাজ দেখে তিনি অবাক হলেন, তাঁর নাম কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। কীভাবে তাঁর দেখানো পথে হেঁটে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ব্ল্যাকহোল, তার বিস্তারিত জানা যাবে এ অধ্যায়ে। সঙ্গে শোয়ার্জশিল্ড ও আইনস্টাইনের মধ্যে চিঠি চালাচালি এবং তৎকালীন বিশ্বের অবস্থাও আঁচ করা যাবে।
তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ‘বহুদূর থেকে আসা ঢেউ’। এই ডেউ আসলে মহাকর্ষ তরঙ্গ। পানিতে ঢিল ছুড়লে যেমন অনেক দূর থেকে ঢেউ আসে, মহাবিশ্বের কোনো প্রান্ত থেকে কি পৃথিবীতে তেমন মহাকর্ষ তরঙ্গের ঢেউ আসতে পারে? দুটি বিশালাকার কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেলে অবশ্য তেমন ডেউ আসতে পারে। কিন্তু সে ঢেউ ধরার যন্ত্র তো লাগবে। বানানো হলো সেই যন্ত্র। একদিন তাতে সিগন্যাল ধরাও পড়ল।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা কি তা ঠিক ধরতে পারলেন, নাকি ভুল কোনো সিগন্যাল ধরা পড়েছে? আসলেই কি বহু দূর মহাকাষ থেকে ভেসে এসেছে এই সিগন্যাল? প্রথম মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের অবিশ্বাস্য এ কাহিনিতে রয়েছে রোমাঞ্চকর টুইস্ট। ২০১৫ সালে সিগন্যাল পেলেও কেন আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করে মহাকর্ষ তরঙ্গের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়? কেন ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নাল বাতিল করে দিয়েছিল আইনস্টাইনের পেপার? পেপারে ভুল ছিল, নাকি ভুলটা করেছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং? মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সবকিছু।
উইলিয়াম হার্শেল একজন সুরকার। সময় পেলে বোনকে নিয়ে টেলিস্কোপে আকাশ দেখেন। একদিন একটা আলোর বিন্দু দেখতে পেলেন। ওটা যে নক্ষত্র বা ধূমকেতু নয়, তা তিনি বুঝতে পারেন। কারণ, সখ করে আকাশ দেখলেও এতদিনে এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি সব জানা হয়ে গেছে দুই ভাই-বোনের। অনেক হিসেব করে বোঝা গেল, ওটা একটা গ্রহ। নাম দেওয়া হলো ইউরেনাস। হার্শেলের তো পোয়াবারো, কিন্তু জীবনের বারোটা বেজে গেল কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর। গাণিতিক হিসেবে ইউরেনাসের কক্ষপথ ঠিক মিলছে না। কোথাও একটা গোলমাল আছে। কী সেই গোলমাল, তা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে জানা যাবে এসব কাহিনি।
পরের অধ্যায়ে জানা যাবে ম্যাক্সওয়েল ও মাইকেল ফ্যারাডেকে নিয়ে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে ম্যাক্সওয়েলের মনে প্রশ্ন জাগল, আলো কী? উত্তরটাও নিজেই ঠিক করলেন। আর সে কথা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রশ্নটা আসলে হঠাৎ ম্যাক্সওয়েলের মনে আসেনি। গতরাতেই হিসেবে কষে একটা গাণিতক সমাধান পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে মাইকেল ফ্যারাডে কোথায়? আছেন তো! বইয়ের দোকানের কর্মচারী থেকে পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন—এও আরেক রোমাঞ্চকর গল্প। এই গল্পের সঙ্গে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের সম্পর্ক কী? ফ্যারাডে ও ম্যাক্সয়েল কতটা অবদান রেখেছেন বিজ্ঞানে? এসব গল্প পড়তে পড়তে জানতে পারবেন আল বিরুনি, আল হাজেনসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর অবদানের কথা।
বইয়ের শেষ দুটি অধ্যায় আইনস্টাইন, বিশেষ আপেক্ষিকতা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে। এক সময় মনে করা হতো, কোনোকিছু মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। তার মানে আলোরও মাধ্যম লাগবে। সেই মাধ্যমের নাম দেওয়া হয় ইথার। কিন্তু এই ইথার জিনিসটা কেউ কোনোদিন চোখেই দেখেনি। এ সম্পর্কে সব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় না। যাবে কীভাবে, সবটাই যে গোঁজামিলে ভরা! সেই গোঁজামিল দূর করলেন আইনস্টাইন। কীভাবে? জানতে হলে পড়তে হবে আবিষ্কারের কাহিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।