লক্ষ্মী রানী বাড়ৈ: ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, নিরাকার এবং সর্বশক্তিমান। মহামনীষিরা এই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে থাকেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ব্রহ্মের উপলব্ধি এবং উপসনা করা খুবই কঠিন। তাই যুগে যুগে ভগবান তার অসীম শক্তির রুপান্তর ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুপে অবতীর্ন হয়ে মানুষের মনে প্রাণে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য, বিশ্বাস উপলব্ধি ও চেতনা আণয়ন করেন।
দুর্গাপূজা সেই নিরাকার ব্রহ্মের মাতৃরুপেরই আরাধনা। যে শক্তি বিশ্বাস চরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে, যার আদি নেই, অন্ত নেই, যা সর্বত্র বিরাজ মান, যার অস্তিত্ব স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল পযর্ন্ত বিস্তৃত সেই মহা শক্তির প্রকাশই দেবীমহামায়া শ্রী শ্রী দুর্গা। তিনি সর্বশিক্তসমম্বিতা, সর্বব্যপিণী, সর্বমঙ্গলকাঙ্গণী, সর্বশত্রুনাশিণী, সর্বপাপবিনাশিণী, বৈঞ্চবশক্তিরুপিণী, জগজ্জননী, সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির মহাশক্তি ও মহামায়া। যুগে যুগে এই পূজার মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বী সকল মানুষ মহামিলনে মিলিত হয়। সকল দু:খ কষ্ট ভুলে গিয়ে সৌহার্দের এক মধু মহিমা তৈরী হয় এই উৎসবকে ঘিরে। শত্রুতা ভুলে গিয়ে একে অপরের অতি কাছাকাছি যাওয়ার এটাই মহাসুযোগ।
এই সার্বজনীন দুর্গোৎসব শুধু হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, সকল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ উৎসবকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক সৌহার্দময় প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধন। দশে মিলি কাজ করার এক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয় দেবী দুর্গার আরাধনায়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সব ধরনের সামগ্রীর মহাসমন্বয় ঘটে দেবীপূজার অনুষ্ঠানে। দেবীদুর্গা যেমন সকল দেব শক্তির সম্মিলিত প্রতীকশক্তি, তেমন সকল মানুষের মিলনের মাধ্যমে সম্মিলিত শুভশক্তির আবিভার্ব ঘটে এই দেবীর পূজার মন্দিরস্থলে। সামাজিক ভাবে অর্থনৈতিক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সকল শ্রেণীপেশার মানুষেরই শ্রমশক্তির মিলন ঘটে এই পূজাকে ঘিরে। ঘটে মহাঐক্য, মহাসংহতি, মহাপার্বন, মহামিলন ও শ্রমের মহাসমন্বয়।
বাঙালি হিন্দুরা শ্বারদীয় দুর্গাপূজা করে আসছে আদিকাল হতে। আর এভাবেই পরিণত হয়ে আসছে শ্বাশত বাংলার এক অপরূপ মিলনমেলার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এর প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের আয়োজন অনুষ্টিত হয়। এতে সম্পৃক্ত হয় মানুষের মন। মাতৃ আরাধনার এই পরমলগ্নে মায়ের কাছে নতজানু হয়ে চাওয়ার এবং পাওয়ার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠি। খানিকটা হলেও অন্তরের কালিমা মোচন করে একাগ্রচিত্তে দেবীর পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করি। মানুষের মন প্রাণ যত কঠিন হোক, দেবীর পায়ের কাছে নতজানু হলে মানুষের সংকীর্নতা মুছে যায়, ভুলে যায় হিংসা বিদ্বেষ, প্রাণে ভালোবাসা সঞ্চালিত হয়, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুরিত হয় দেবীর কল্যাণময়ী বার্তা। এই অনুভূতি মানব সমাজকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। দেবীর আরাধনা মানুষের মন সংযমতায় পরিপূর্ণ হয় ফলে দূর্নীতি, সন্ত্রাস, অরাজকতা, অন্যায় ও পাপের পথ মানুষ ভুলে যায়। সমাজ হয়ে উঠে কলুষমুক্ত।
নারীরূপী মায়ের চরণে নারী হৃদেয়র আকূল আকুতি লিখেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘নারী সর্বশক্তিময়ী’ কবিতায়।আজ স্তুতি যত আমার নারীরূপী মা শ্রীদুর্গার চরণে। মা সন্তানকে লালন-পালন করেন, সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করেন, সন্তানকে রক্ষা করেন। ‘মা’ নাম সন্তানের কাছে অত্যন্ত মধুর। ‘মা’ নাম করলে শক্তির ভাব, সর্বশক্তিমত্তা ঐশ্বরিক শক্তির ভাব এসে থাকে; শিশু নিজের মাকে সর্বশক্তিময়ী মনে করে, ভাবে ‘মা’ সব করতে পারে। মাতৃরূপে তিনি সত্বর আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা মাতৃভাবে সর্বব্যাপিনী মহাশক্তির পূজা। দুর্গাপূজার প্রতিমায়ও সেই ভাবের ব্যঞ্জনা ফুটে উঠে। মা দশ দিক থেকে দশ হাতে আমাদের রক্ষা করছেন। অসুররূপী আমাদের সমস্ত অশুভভাবকে বিনাশ করছেন।
নারী সর্বশক্তিময়ী কথা না বলে করা হোক নারীকে শক্তিশালী। শুধু দেবীর সাথে তুলনা করে কি লাভ? দেয়া হোক শক্তির ভিত্তি জাগতিক অধিকার- শ্রী শ্রী মা দুর্গার শ্রীচরণে এই অর্ঘ্য আমার। দুর্গাপূজার এই পবিত্র তিথীতে সর্বব্যাপিনী, মাতৃরূপীনি, নারীরূঙ্গনী, শক্তিরূপিণী, জগ্জ্জননী সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির শক্তি দেবী মহামায়ার কাছে আমরা আকুল হয়ে প্রার্থনা করি নিজের, অপরের, সমাজের, দেশের এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর জন্য – হে দেবী জগজ্জননী মা তোমার কৃপায় আমার কৃপান্বিত হই, আমাদের অন্তরের বাহিরের সমাজের তথা দেশের সকল অসুরিক শক্তির, ক্রমবর্ধমান পাশবিক শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে তুমি মাতৃরূপে সকল মানুষকে ক্ষমা করে শুদ্ধ কর, পরিপূর্ণ কর, তোমার শান্তির সুবাতাস দিয়ে ধরিত্রীকে সুবাসিত করো, সত্য সুন্দরের আলোতে পরিপূর্ণ করো, কল্যাণ ও শান্তির স্নিগ্ধ সৌরভে সুরভিত করো এই অগ্নিময় ধরাকে ও তাপিত মানুষকে। পৃথিবী শান্তিময় হোক এই আরাধনা সর্বভূতে আর্বিভূতা দেবী মহামায়া শ্রীশ্রী দুর্গার পাদপাদ্মে।
লক্ষ্মী রানী বাড়ৈ: ইভ্যালুয়েশন অফিসার (অবসরপ্রাপ্ত) এম আই এস ইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।