আজ সকালে রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে আবারও এক মর্মান্তিক সংঘর্ষের খবর এলো। কনকনে শীতের কুয়াশায় ঢাকা পথে ট্রাকের ধাক্কায় উল্টে গেল একটি প্রাইভেট কার। চোখের পানি মুছতে মুছতে পুলিশ জানাল, সিট বেল্ট না পরা ও অতিরিক্ত গতিই ছিল মূল কারণ। এই দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (BRTA) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস না জানা এবং না মানার ফলেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬৪টি প্রাণ ঝরে যাচ্ছে শুধু সড়কেই। শুধু লাইসেন্স থাকলেই কি একজন দক্ষ চালক হওয়া যায়? নাকি জীবনের এই পিচ্ছিল পথে নিরাপদে টিকে থাকতে চাই দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস-এর গভীর জ্ঞান ও নিয়মিত চর্চা? আসুন, জেনে নিই সেই জীবন রক্ষাকারী কৌশলগুলো, যেগুলো আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
১. দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস: মৌলিক নিরাপত্তা যেভাবে নিশ্চিত করবেন (The Foundation of Safe Driving)
ড্রাইভিং শুধু গাড়ি সামনে নিয়ে চলা নয়; এটি একটি জটিল দায়িত্ব, যেখানে আপনার হাতেই থাকে আপনার ও অন্যদের জীবনের নিরাপত্তা। দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস শুরুতেই জোর দেয় মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর, যা অনেকেই অবহেলা করেন।
সিট বেল্ট: আপনার প্রথম রক্ষাকবচ: এটি শুধু আইন নয়, বাঁচার হাতিয়ার। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৪০% এরও বেশি সিট বেল্ট না পরার কারণে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু ড্রাইভার নন, গাড়ির প্রতিটি যাত্রীকেই বেল্ট পরতে হবে। ছোট শিশুদের জন্য উপযুক্ত চাইল্ড সিট ব্যবহার অপরিহার্য – এটি টক্করের সময় শিশুকে ধরে রাখে এবং মারাত্মক আঘাত থেকে রক্ষা করে। মনে রাখবেন, পিছনের সিটেও বেল্ট পরা সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এ সিট বেল্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
গতি নিয়ন্ত্রণ: ধীরে চলুন, নিরাপদে থাকুন: “গতি যত বেশি, বিপদ তত কাছে” – এই কথাটি ড্রাইভিং এর ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। আবহাওয়া, রাস্তার অবস্থা, যানবাহনের ঘনত্ব এবং দৃশ্যমানতার ওপর ভিত্তি করে গতি সামঞ্জস্য করুন। ঢাকার মত শহরে যেখানে হঠাৎ পথচারী রাস্তা পার হতে পারে বা অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়ি থেমে যেতে পারে, সেখানে স্কুল, হাসপাতাল বা ব্যস্ত বাজারের কাছে গতি অবশ্যই কমাতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস এ সবসময় পরামর্শ দেওয়া হয়, গাড়ির গতি বাড়ানোর আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: “এই গতিতে কি আমি হঠাৎ থামতে পারব?” মনে রাখবেন, গতি দ্বিগুণ করলে থামার দূরত্ব চার গুণ বেড়ে যায়!
দূরত্ব বজায় রাখা: নিরাপদ ফাঁকা জায়গা কেন জরুরি? গাড়ি চালানোর সময় সামনের গাড়ির সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা (Following Distance) দুর্ঘটনা এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। “থ্রি-সেকেন্ড রুল” মেনে চলুন: সামনের গাড়ি কোন একটি স্থির বিন্দু (যেমন: গাছ, বিলবোর্ড) অতিক্রম করার পর আপনার গাড়ি সেখানে পৌঁছাতে অন্তত তিন সেকেন্ড সময় লাগবে – এটিই সাধারণ অবস্থায় ন্যূনতম নিরাপদ দূরত্ব। বৃষ্টি, কুয়াশা বা রাতে এই দূরত্ব বাড়িয়ে পাঁচ সেকেন্ড বা তারও বেশি করুন। ঢাকার মত শহরে যেখানে হঠাৎ ব্রেক লাইট জ্বলার সম্ভাবনা বেশি, নিরাপদ দূরত্ব আপনাকে প্রতিক্রিয়া জানানোর এবং থামার পর্যাপ্ত সময় দেবে।
- মনোযোগ: ড্রাইভিং-ই যখন আপনার একমাত্র কাজ: মোবাইল ফোনে কথা বলা, মেসেজ করা, জিপিএস সেট করা, গান বদলানো, এমনকি অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তীব্র আলোচনাও ড্রাইভারের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ (National Road Safety Council – NRSC) এর মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ ডিস্ট্র্যাক্টেড ড্রাইভিং বা মনোযোগ বিচ্ছিন্ন ড্রাইভিং। ফোন ব্যবহার করতে হলে গাড়ি পার্ক করে নিন বা হ্যান্ডস-ফ্রি ব্যবহার করুন (যদিও এটি সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়)। ভ্রমণের আগেই গন্তব্য সেট করে নিন। মনে রাখবেন, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অমনোযোগই জীবনে চিরকালের জন্য আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২. চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে ড্রাইভিং: বৃষ্টি, কুয়াশা ও রাতে নিরাপদ থাকার কৌশল (Driving in Adverse Conditions)
বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং রাস্তার পরিস্থিতি প্রায়শই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস শুধু স্বাভাবিক অবস্থার জন্যই নয়, এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ নির্দেশনা দেয়।
বৃষ্টি ও পিচ্ছিল রাস্তা: স্লিপারি রোডে ট্র্যাকশন ধরে রাখুন: বৃষ্টি শুরুর প্রথম কয়েক মিনিট সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ রাস্তার তেল ও ময়লা পানির সাথে মিশে একধরনের সাবানী স্তর তৈরি করে, যা টায়ারের গ্রিপ কমিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ড্রাইভিং করার সময়:
- গতি কমিয়ে ফেলুন: শুষ্ক রাস্তার তুলনায় গতি উল্লেখযোগ্যভাবে (প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) কমিয়ে দিন।
- হেডলাইট চালু করুন: শুধু নিজে দেখার জন্য নয়, অন্য গাড়িকে আপনাকে দেখার সুযোগ দিতেই (লো-বিম ব্যবহার করুন)।
- হাইড্রোপ্লেনিং থেকে সাবধান: গাড়ির টায়ার যখন রাস্তার পানির স্তরের উপর দিয়ে ভেসে যায়, তখনই হাইড্রোপ্লেনিং হয়। এ অবস্থায় ব্রেক বা স্টিয়ারিং কোনোটাই কাজ করে না। হাইড্রোপ্লেনিং এড়াতে গভীর পানি এড়িয়ে চলুন, হঠাৎ করে ব্রেক না চেপে ধীরে ধীরে গ্যাস ছাড়ুন, এবং স্টিয়ারিং সোজা রাখুন।
- ব্রেকের ব্যবহার সতর্কতার সাথে: জরুরি অবস্থায় ব্রেক কয়েকবার হালকা করে চাপ দিন (পাম্প করুন) অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম (ABS) থাকলে জোরে ব্রেক চেপে ধরে রাখুন এবং স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের গাইডলাইন বৃষ্টিতে ড্রাইভিং সম্পর্কে বিস্তারিত পরামর্শ দেয়।
- টায়ার চেক করুন: পর্যাপ্ত ট্রেড গভীরতা (ন্যূনতম ১.৬ মিমি) এবং সঠিক টায়ার প্রেশার বৃষ্টিতে গ্রিপ বাড়াতে সাহায্য করে।
কুয়াশা: অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি: ঘন কুয়াশায় দৃশ্যমানতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। এই অবস্থায়:
- ফগ লাইট ব্যবহার করুন: আপনার গাড়িতে ফগ লাইট থাকলে তা চালু করুন (সাধারণ হেডলাইটের চেয়ে এগুলো নিচু ও বিস্তৃত আলো ছড়ায় যা কুয়াশা ভেদ করতে সাহায্য করে)। উচ্চ বিম (হাই-বিম) কখনোই ব্যবহার করবেন না। এটি কুয়াশায় আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে আপনার নিজের দৃষ্টিও ঝাপসা করে দেবে এবং বিপরীত দিকের চালকদেরও অন্ধ করে দিতে পারে।
- গতি কমানো অত্যন্ত জরুরি: কুয়াশার ঘনত্ব যত বেশি, গতি তত কমাতে হবে। যতটা দূর আপনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছেন, তার মধ্যে গাড়ি থামানো সম্ভব – এমন গতিতে চলুন।
- রাস্তার মার্কিং অনুসরণ করুন: সড়কের ডান দিকের সাদা লাইন বা রোড এজ মার্কিং অনুসরণ করে আপনার লেনে থাকুন।
- হ্যাজার্ড লাইট (ইন্ডিকেটর) ব্যবহার নয়: কুয়াশায় চলাকালীন হ্যাজার্ড লাইট (জরুরি ফ্ল্যাশার) ব্যবহার করবেন না। এটি অন্য চালকদের বিভ্রান্ত করতে পারে যে আপনার গাড়ি থেমে আছে বা কোন সমস্যা হয়েছে। শুধু লো-বিম ও ফগ লাইট ব্যবহার করুন। বিপরীত দিকের গাড়ি এলে সাময়িকভাবে ফগ লাইটও বন্ধ করে দিতে পারেন দৃষ্টি স্বচ্ছতার জন্য।
- রাতের ড্রাইভিং: অন্ধকারে দৃষ্টি সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা: রাতে দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই কমে যায় এবং ক্লান্তিও বাড়ে। রাতে নিরাপদ ড্রাইভিং এর জন্য:
- হেডলাইট পরিষ্কার ও সঠিকভাবে সেট করুন: নোংরা হেডলাইট আলোর তীব্রতা কমায়। নিয়মিত পরিষ্কার করুন এবং সঠিক অ্যাঙ্গেলে সেট আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
- হাই-বিমের সঠিক ব্যবহার: খোলা সড়কে বিপরীত দিকে কোন যানবাহন না থাকলে হাই-বিম ব্যবহার করুন দৃষ্টি বাড়ানোর জন্য। বিপরীত দিক থেকে গাড়ি এলে বা সামনের গাড়ির পিছনে থাকলে অবশ্যই লো-বিমে চালু করুন। হাই-বিমে থাকা অবস্থায় বিপরীত দিকের চালকের চোখে আলো পড়লে তা অন্ধকারে খাপ খাওয়ানোর তার ক্ষমতা সাময়িকভাবে নষ্ট করে দেয় (নিশাচর অন্ধত্ব), যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
- ক্লান্তি এড়িয়ে চলুন: রাত, বিশেষত মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত, ক্লান্তি জনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। ঘুম পেলে কখনোই গাড়ি চালাবেন না। নিয়মিত বিরতি নিন, হালকা নাস্তা করুন, কফি খান (যদিও এটি সাময়িক সমাধান), এবং সম্ভব হলে ড্রাইভার বদল করুন।
- প্রাণী ও পথচারীদের জন্য সতর্ক থাকুন: রাতে গ্রামীণ বা শহরতলির রাস্তায় প্রাণী বা অন্ধকার পোশাক পরিহিত পথচারী হঠাৎ রাস্তায় আসতে পারে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ বা জনবহুল এলাকার কাছে অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।
৩. গাড়ির যত্ন ও প্রস্তুতি: আপনার যানই আপনার নিরাপত্তার প্রথম স্তর (Vehicle Maintenance: Your First Line of Defense)
নিরাপদ ড্রাইভিং শুধু দক্ষতার বিষয় নয়, আপনার যানবাহনের যান্ত্রিক সক্ষমতার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করে গাড়ির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণকে।
টায়ার: রাস্তার সাথে সংযোগ স্থাপনকারী: টায়ারই আপনার গাড়িকে রাস্তার সাথে সংযুক্ত রাখে। তাই এর অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- চাপ (প্রেশার) নিয়মিত চেক করুন: মাসে অন্তত একবার এবং দীর্ঘ ভ্রমণের আগে অবশ্যই টায়ারের প্রেশার ম্যানুফ্যাকচারারের সুপারিশ অনুযায়ী ঠিক আছে কিনা চেক করুন। কম বা বেশি প্রেশার দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়, টায়ারের আয়ু কমায় এবং জ্বালানি খরচ বাড়ায়। প্রেশার চেক করুন গাড়ি ঠাণ্ডা থাকা অবস্থায় (চালানোর পর অন্তত তিন ঘণ্টা পর)।
- ট্রেড গভীরতা পরীক্ষা করুন: টায়ারের ট্রেডের গভীরতা (Groove Depth) ন্যূনতম ১.৬ মিলিমিটার (বাংলাদেশী আইন অনুযায়ী) হওয়া আবশ্যক। একটি সহজ টাকা পরীক্ষা: একটি এক টাকার কয়েন টায়ারের খাঁজে উল্টো দিক থেকে ঢুকান। যদি কয়েনের বাহিরের রিংটা দেখা যায়, তাহলে টায়ার পরিবর্তনের সময় এসেছে। পর্যাপ্ত ট্রেড না থাকলে বৃষ্টিতে হাইড্রোপ্লেনিংয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং ব্রেকিং দূরত্ব দীর্ঘ হয়।
- সামগ্রিক অবস্থা: টায়ারে কোন কাটা, ফোলা, ফাটা বা অস্বাভাবিক ঘষা (Uneven Wear) আছে কিনা পরীক্ষা করুন। অস্বাভাবিক ঘষা হুইল অ্যালাইনমেন্ট বা সাসপেনশন সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
ব্রেক: জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা: ব্রেক সিস্টেমে কোন সমস্যা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। নিয়মিত সার্ভিসিংয়ের সময় ব্রেক প্যাড/শুরের পুরুত্ব, ব্রেক ফ্লুইডের লেভেল ও অবস্থা, ব্রেক লাইনে কোন লিকেজ আছে কিনা চেক করান। ব্রেক চেপে গাড়ি থামানোর সময় যদি কোন অস্বাভাবিক শব্দ (চিৎকার, ঘর্ষণ), কম্পন বা ব্রেক প্যাডেল নরম/স্পঞ্জি লাগে, অবিলম্বে একজন যোগ্য মেকানিক দ্বারা পরীক্ষা করান। BRTA নির্দেশিকা গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য ব্রেক সিস্টেমের সঠিক কার্যকারিতা বাধ্যতামূলক করেছে।
লাইট ও ইন্ডিকেটর: অন্যকে জানান আপনার উপস্থিতি ও অভিপ্রায়: সব হেডলাইট (লো-বিম, হাই-বিম), টেইল লাইট, ব্রেক লাইট, টার্ন সিগন্যাল (ইন্ডিকেটর), হ্যাজার্ড লাইট এবং রিভার্স লাইট নিয়মিত চেক করুন। কোন বাল্ব নষ্ট হলে বা লেন্স ফাটলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করুন। পরিষ্কার লেন্স সর্বোচ্চ আলো নিঃসরণ নিশ্চিত করে। ইন্ডিকেটর ব্যবহার করুন লেন পরিবর্তন, মোড় নেওয়া বা পার্কিং শুরু ও শেষ করার আগে, যাতে পেছনের ও বিপরীত দিকের গাড়ি আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে পারে।
উইন্ডশীল্ড ও ওয়াইপার: পরিষ্কার দৃষ্টি নিশ্চিতকরণ: ফাটলমুক্ত উইন্ডশীল্ড এবং কার্যকর ওয়াইপার ব্লেড অপরিহার্য, বিশেষ করে বৃষ্টি বা ধুলোবালির সময়। উইন্ডশীল্ডে কোন বড় ফাটল থাকলে তা দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং দুর্ঘটনার সময় সহজেই ভেঙে যেতে পারে। ওয়াইপার ব্লেড যদি উইন্ডশীল্ডে দাগ ফেলে বা শব্দ করে, তাহলে তা পরিবর্তনের সময় এসেছে। উইন্ডশীল্ড ওয়াশার ফ্লুইড নিয়মিত ভরুন এবং শীতকালে ফ্রিজিং প্রতিরোধী ফ্লুইড ব্যবহার করুন।
- নিয়মিত সার্ভিসিং: প্রতিরোধই সর্বোত্তম নিরাময়: ম্যানুফ্যাকচারারের সুপারিশকৃত সার্ভিসিং সিডিউল মেনে চলুন। নিয়মিত তেল-ফিল্টার পরিবর্তন, ফ্লুইড চেক (কুল্যান্ট, ব্রেক ফ্লুইড, পাওয়ার স্টিয়ারিং ফ্লুইড), বেল্ট ও হোস পরিদর্শন এবং সামগ্রিক যান্ত্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছোটখাটো সমস্যাকে বড় দুর্ঘটনায় পরিণত হওয়ার আগেই ধরে ফেলতে সাহায্য করে।
৪. বাংলাদেশের রাস্তায় বিশেষ সতর্কতা: স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা (Navigating Bangladeshi Roads: Local Nuances)
বাংলাদেশের রাস্তায় ড্রাইভিং অনেক সময় ভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস এখানে স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষ পরামর্শ প্রয়োজন।
অপ্রত্যাশিত বাধা ও পথচারী: বাংলাদেশের রাস্তায় যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে পথচারী, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, এমনকি গবাদি পশুও উঠে আসতে পারে, বিশেষ করে শহরতলি ও গ্রামীণ এলাকায়। সর্বদা স্ক্যানিং চালিয়ে যান – সামনে, পেছনে, পাশে এবং ব্লাইন্ড স্পট চেক করুন। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার বা জনসমাগমের স্থানের কাছে গতি অবশ্যই কমিয়ে দিন এবং অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন। ধরে নিন যে পথচারী বা অন্যান্য রাস্তার ব্যবহারকারীরা আপনার গাড়ি দেখতে পাচ্ছেন না বা আপনার গতি সম্পর্কে ভুল অনুমান করছেন।
রিকশা, সিএনজি ও অনিয়মিত ট্রাফিক প্রবাহ: রিকশা, সিএনজি বা অন্যান্য থ্রি-হুইলার হঠাৎ করে লেন পরিবর্তন করতে পারে, অপ্রত্যাশিতভাবে থামতে পারে বা মোড় নিতে পারে। এদের সাথে থাকার সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন। তাদের আচরণ অনুমান করা কঠিন, তাই বেশি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। হর্নের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলুন; এতে শুধু শব্দ দূষণই হয়, প্রায়শই এটি কার্যকরও হয় না। ধৈর্য ধরুন এবং ওভারটেক করার সময় সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে নিন।
রাস্তার অবস্থা: গর্ত, সংস্কার ও জলাবদ্ধতা: ঢাকা শহর বা আন্তঃজেলা মহাসড়ক – রাস্তার গর্ত (পথকূপ) একটি বড় সমস্যা। গর্তের কারণে হঠাৎ স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ হারানো, টায়ার ফেটে যাওয়া বা সাসপেনশন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রাস্তার দিকে ভালোভাবে নজর রাখুন এবং সম্ভাব্য গর্ত আগে থেকে শনাক্ত করার চেষ্টা করুন। জলাবদ্ধ এলাকায় ড্রাইভিং এড়িয়ে চলুন। ভিজে গেলে কতটা গভীর তা বোঝা যায় না, এবং গাড়ি স্টল বা ইঞ্জিন ড্যামেজ হতে পারে। সংস্কারকাজের জায়গায় সতর্কতা লক্ষণ (কোন সাইনবোর্ড, ট্রাফিক কন) মেনে চলুন এবং গতি কমিয়ে দিন।
ওভারটেকিং: কখন, কোথায় এবং কীভাবে? বাংলাদেশের দুই লেনের সড়কে বিপজ্জনক ওভারটেকিং একটি প্রধান দুর্ঘটনার কারণ। ওভারটেক করার আগে সর্বদা নিশ্চিত হোন:
- সামনে পর্যাপ্ত দৃশ্যমানতা আছে (সোজা, খোলা রাস্তা, কোন কার্ভ বা উঁচু স্থান নেই)।
- বিপরীত দিক থেকে কোন যানবাহন আসছে না (দূরত্ব ও গতি সঠিকভাবে অনুমান করুন)।
- সামনের গাড়ি ওভারটেকিং এর জন্য জায়গা দিচ্ছে বা আপনি নিরাপদে ফিরে আসতে পারবেন।
- আপনার গাড়ির সক্ষমতা আছে দ্রুত ওভারটেক করার।
কখনই কার্ভ, ব্রিজের উপর, ট্রাফিক জংশনে বা স্কুল/হাসপাতালের কাছে ওভারটেক করবেন না। ইন্ডিকেটর দিয়ে সঠিকভাবে সংকেত দিন।
- ট্রাফিক আইন ও সংকেত মেনে চলা: লাল বাতি, স্টপ সাইন, ওয়ান-ওয়ে স্ট্রিটের নিয়ম, স্পিড লিমিট, ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এলাকা – এই আইনগুলো নিরাপত্তার জন্য তৈরি। এগুলো ভাঙা শুধু জরিমানার বিষয় নয়, মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। জেব্রা ক্রসিং এ পথচারীদের অগ্রাধিকার দিন।
জেনে রাখুন (FAQs):
প্র: ড্রাইভিং টিপস জানা সত্ত্বেও কেন দুর্ঘটনা ঘটে?
- উ: দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস জানা এবং তা নিয়মিত অনুশীলন করা একই বিষয় নয়। অনেক সময় চালকরা টিপস জানেন, কিন্তু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভুল করেন, বিশেষ করে চাপের মধ্যে। মনোযোগ বিচ্ছিন্নতা (ফোন), অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, ক্লান্তি, মাদক বা মদ্যপান, আবেগের বশে ড্রাইভিং, এবং গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটিও বড় কারণ। টিপসগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করতে সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
প্র: বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ সিট কোনটি?
- উ: গাড়ির পিছনের সিট, বিশেষ করে মাঝের আসনটি (যদি সেখানে সিট বেল্ট থাকে এবং সঠিকভাবে ইনস্টল করা সম্ভব হয়) সাধারণত সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত, কারণ এটি ফ্রন্টাল ও সাইড ইমপ্যাক্ট থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাচ্চার বয়স, ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ধরনের চাইল্ড রেস্ট্রেইন্ট সিস্টেম (সিট) ব্যবহার করা এবং গাড়ির ম্যানুয়াল ও সিটের নির্দেশিকা অনুযায়ী সঠিকভাবে ইনস্টল করা। ১২ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের পেছনের সিটে বসানো উচিত। BRTA শিশু নিরাপত্তা নির্দেশিকা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানায়।
প্র: ব্রেক ফেল করলে কি করব? (ব্রেক কাজ না করলে)
- উ: এটি একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। শান্ত থাকার চেষ্টা করুন। প্রথমে ব্রেক প্যাডেল কয়েকবার দ্রুত পাম্প করুন – কখনো কখনো ব্রেক ফ্লুইডের চাপ ফিরে আসতে পারে। যদি কাজ না করে, ধীরে ধীরে ইঞ্জিন ব্রেক (গিয়ার ডাউনশিফটিং) এবং পার্কিং ব্রেক (হ্যান্ড ব্রেক) ব্যবহার করুন, তবে পার্কিং ব্রেক খুব ধীরে ধীরে ও নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগ করুন, নাহলে গাড়ি আনকন্ট্রোলেবলভাবে ঘুরে যেতে পারে। হ্যাজার্ড লাইট জ্বালান। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার আগে নিরাপদ স্থানে (যেমন রাস্তার ধারের মাটি, বালি) গাড়ি ঘষে থামানোর চেষ্টা করুন। রাস্তা থেকে অন্য গাড়িকে সরে যেতে সতর্ক করুন (হর্ন, হেডলাইট ফ্ল্যাশ)।
প্র: রাতে হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে গেলে (গ্লেয়ার) কি করব?
- উ: বিপরীত দিকের গাড়ির হাই-বিম আপনার চোখে পড়লে, রাস্তার ডান দিকে (বাংলাদেশে) তাকান (সাদা রোড এজ লাইনের দিকে), হাই-বিম চালু করা গাড়ির দিকে সরাসরি না তাকিয়ে। এটি সাময়িক অন্ধত্ব কমাতে সাহায্য করে। নিজে কখনোই প্রতিশোধমূলকভাবে হাই-বিম চালু করবেন না – এটি পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। আপনার চোখ ধাঁধালে গতি কমিয়ে ফেলুন যতক্ষণ না দৃষ্টি স্বচ্ছ হচ্ছে।
- প্র: বাংলাদেশে ডিফেন্সিভ ড্রাইভিং কোর্স কোথায় পাওয়া যায়?
- উ: ডিফেন্সিভ ড্রাইভিং শেখার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপপক্ষ (BRTA) অনুমোদিত ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারগুলো। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও উন্নত ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ঢাকার মিরপুর, উত্তরা, এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরের BRTA অফিসে এই তথ্য পাওয়া যায়। BRTA ওয়েবসাইট বা স্থানীয় অফিসে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তালিকা জেনে নিন। ডিফেন্সিভ ড্রাইভিং শেখা দুর্ঘটনার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
চূড়ান্ত বার্তা:
দুর্ঘটনা এড়াতে ড্রাইভিং টিপস শুধুমাত্র কিছু নিয়মের তালিকা নয়, এগুলো হল অভিজ্ঞতালব্ধ সেইসব মূল্যবোধ যা আপনার হাতল ধরে থাকা হুইলটিকেই জীবন ও মৃত্যুর সেতুবন্ধনে পরিণত করতে পারে। আজকে এই মুহূর্তে আপনার গাড়ির সিট বেল্টটি পরা, গতি সামান্য কমিয়ে আনা, সামনের গাড়ির সাথে আরেকটু দূরত্ব রাখা, বা ফোনে না তাকানোর সিদ্ধান্তটিই হয়তো কালকের একটি মর্মান্তিক সংবাদের শিরোনাম হওয়া থেকে আপনাকে এবং আপনার প্রিয়জনকে রক্ষা করবে। মনে রাখবেন, রাস্তায় প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি সিদ্ধান্ত অমূল্য। আপনি কতটা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছালেন, তা নয়; আপনি কতটা নিরাপদে পৌঁছালেন, সেটাই আসল কথা। গাড়ি চালানোর সময় সতর্ক থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন, এবং প্রতিটি যাত্রাকে নিরাপদ যাত্রায় পরিণত করার দায়িত্ব আজই নিজের কাঁধে নিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।