জ্যোতির্বিজ্ঞান, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহীমাত্রই জানেন, বিগ ব্যাং ঘটেছিল আজ থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ ১৩৮০ কোটি বছর আগে (১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি বছর)। এর প্রথম ৩০০ মিলিয়ন বছরের মতো মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকার।
পদার্থ-প্রতিপদার্থের সংঘর্ষ ও মৌলিক কণাদের স্যুপ বা ঝোলে বারবার বাধা পেয়েছে ফোটন। প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন বছর পরে সৃষ্টি হয় মহাবিশ্বের প্রথম পরমাণু। ইলেকট্রনের মতো অস্থির কণা বাঁধা পড়ে প্রোটনের চারপাশে। তখন আলোয় ভেসে যায় মহাবিশ্ব। তার মানে, আমাদের প্রায় ১৩০০ কোটি বা ১৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বেশি মহাবিশ্ব দেখতে পাওয়ার কথা নয়।
গুগল মামা সব জানে। কাজেই, গুগলে চট করে সার্চ করলেই দেখবেন, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। ব্যাসার্ধ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। খুব স্বাভাবিকভাবেই মাথায় ধাক্কা মারার কথা প্রশ্নটার—কীভাবে?
ঝামেলাটা আলোর বেগে। মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল বিষয় হিসাবে ধরে নিয়েছেন, আলোর বেগই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বেগ। এর চেয়ে জোরে ছুটতে পারে না কিছুই। তাহলে, ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে কীভাবে?
আমরা যখন দূরত্বের কথা ভাবি, যতই বিষয়টা জানা থাকুক, দূরত্ব বললেই আমাদের মাথায় সরলরেখা ভেসে ওঠে। কিন্তু মহাবিশ্বটা, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের হাত ধরে আমরা জানি, এরকম সরলভাবে কাজ করে না। স্থান-কাল সরল নয়, বক্র। ভরের জন্য স্থান-কাল বেঁকে যায়।
এর উদাহরণ হিসাবে বিখ্যাত ‘স্থান-কালের চাদর’-এর কথা হয়তো শুনেছেন। এ উদাহরণে বলা হয়, স্থান-কাল একটা চাদরের মতো। এতে ভর, যেমন একটা বল রাখলে, বলটা তার চারপাশের চাদর বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে পৃথিবী যে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে, সে আসলে সূর্যের ভরের কারণে বেঁকে যাওয়া চাদরের বাঁকা তল ধরে ঘুরে চলেছে।
এই উদাহরণ থেকে স্থান-কালের বক্রতার বিষয়টি বোঝা যায় বটে, তবে মহাবিশ্বের বিস্তৃতির বিষয়টি ঠিক বোঝা যায় না। এটা বোঝার জন্য একটা বেলুনের কথা ভাবতে হবে। একটা বেলুনের ওপরে বেশ কিছু বিন্দু নিন। তারপর বেলুনটা ফোলাতে থাকুন। দেখা যাবে, এর ওপরের বিন্দুগুলো সব পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বটাও এভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। প্রতিটি গ্যালাক্সি সরে যাচ্ছে পরস্পর থেকে দূরে।
এই বিষয়টি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এডুইন হাবল। তাঁর হাত ধরে আমরা জানতে পারি, গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তো বটেই; যে গ্যালাক্সি যত দূরে, সেটি তত দ্রুত সরে যাচ্ছে দূরে। ডপলার এফেক্ট বা প্রভাবের মাধ্যমে এটা সহজেই বোঝা যায়। হাজারবার এই প্রভাবের কথা শুনেছেন বা পড়েছেন হয়তো। তাই বিস্তারিত না বলে সংক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
একটা ট্রেন বা অ্যাম্বুলেন্স আমাদের দিকে এগিয়ে আসার সময় এর হুইসেল বা সাইরেনের শব্দের তীব্রতা বাড়ে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়। আবার ট্রেন বা অ্যাম্বুলেন্স দূরে সরে গেলে শব্দের তীব্রতা কমে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। আলোর ক্ষেত্রেও এটা খাটে। আলোর তরঙ্গ (পড়ুন, তরঙ্গের উৎস) আমাদের দিকে এগিয়ে এলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়, তখন সেটাকে নীলচে দেখায়। এর নাম নীল সরণ বা ব্লু শিফট।
আর আলোর তরঙ্গ দূরে সরে গেলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। তখন সেটাকে লালচে দেখায়। এর নাম লোহিত বা লাল সরণ। কারণটা আর কিছু নয়, লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, আর নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। কথাটা এভাবেও বলা যায়, বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে লালচে দেখায়, আর কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে নীলচে দেখায়।
হাবল এই বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করেন। দেখেন, গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলোর লাল সরণ হচ্ছে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি আরও দেখলেন, যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তা তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।
এই সরণের হাত মাপার জন্য হাবলের ধ্রুবক ব্যবহার করা হয়। ধ্রুবকটি প্রথম মাপেন হাবল নিজে। তাঁর নাম থেকেই ধ্রুবকের এই নাম। ১৯২৯ সালে মেপে তিনি এর মান পান প্রতি মেগাপারসেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বা ৩১০ মাইল। এর অর্থ, প্রতি ১ মেগাপারসেক দূরের ছায়াপথ আমাদের থেকে সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। ১ পারসেক হলো আলোর বেগের ৩.২৬ আলোকবর্ষের সমান। আর মেগা হলো তার ১০ লাখ গুণ। ১ মেগাপারসেককে কিলোমিটারে বুঝতে হলে ৩০৯ লিখে তার ডানে ১৭টি শূন্য বসাতে হবে।
গত প্রায় ১০০ বছরে হাবলের পরিমাপকে অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ পরিমাপ বলছে, এ ধ্রুবকের মান ৭৪.০৩ ±১.৪২। বর্তমানে ধ্রুবকটির মান ৬৭ থেকে ৭৪ ধরা হয়। আমরা হিসাবের সুবিধার্থে ৭০ ধরে নিই। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ১ মেগাপারসেক দূরের ছায়াপথ আমাদের কাছ থেকে সেকেন্ডে ৭০ কিলোমিটার বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। তার মানে, ১০০ মেগাপারসেক দূরের কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে সেকেন্ডে ৭০০০ কিলোমিটার বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার ৪,৩০০ মেগাপারসেক দূরের গ্যালাক্সিগুলো সরে যাচ্ছে সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে।
দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ; ব্যাস, অর্থাৎ চারদিকে এটি ৯৩ বিলিয়ন বা ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত। এটুকু আসলে গোটা মহাবিশ্ব নয়, তার ক্ষুদ্র একটা অংশ—এটুকু আমরা দেখতে পাই। (বলে রাখি, এমনিতে মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র নেই। তবে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীকে ধরেই হিসেব কষা হয়, কারণ আমরা দেখছি, নিজেদের চারপাশে।) মহাবিশ্ব আসলে আরও অনেক অনেক বড়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।