জুমবাংলা ডেস্ক : এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণেই খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা (২ কোটি সাড়ে ৮ লাখ ডলারের বেশি)। দেশের ইতিহাসে কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ এই নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে রাজধানীর রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে। এর আগে এক কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে, ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ ভারতের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণব্যয়ের চেয়ে প্রায় ১৯ গুণ এবং চীনের চেয়ে প্রায় ১৬ গুণ বেশি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া এই প্রকল্পের আকাশচুম্বী খরচ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমন খরচ বৈশ্বিক মানদণ্ডে অত্যন্ত অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য, একই সঙ্গে দুর্নীতির একটা বিরাট নজির। এখানে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণের খরচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর তুলনায় তিন গুণের বেশি পার ইউনিট এবং দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ৯ গুণের বেশি। কাজেই এটি অস্বাভাবিক।
তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে তুলনা করলে এই খরচ বেশি নয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রামপুরা থেকে আমুলিয়া হয়ে ডেমরা পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা অবকাঠামো নির্মাণে এবং ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা ভূমি অধিগ্রহণে খরচ হচ্ছে।
প্রতি কিলোমিটার সড়কের সব মিলিয়ে নির্মাণ খরচ পড়ছে প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি)। প্রকল্পে ২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে চীন। অর্থাৎ অবকাঠামো নির্মাণের খরচের পুরোটাই আসছে ঋণ হিসেবে। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের জন্য ৩৫ দশমিক ৮৪২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য সহায়ক প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। এই প্রকল্পে সরকার ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। তবে পাঁচ বছর মেয়াদি সহায়ক প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। ফলে ২০২২ সালে নেওয়া মূল প্রকল্পের কাজ শুরুই করা যায়নি। অথচ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) নিয়োজিত করে। পরে ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই কনসোর্টিয়াম অব চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি), চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন (সিআরবিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল (এসপিভি) কোম্পানি গঠন করা হয়।
সূত্র বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল জটিলতা দেখা দিয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে। প্রকল্পের জন্য ৩৫ দশমিক ৮৪২ একর ভূমি অধিগ্রহণ চার দফায় সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনৈতিক নানা জটিলতা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতায় সে কাজ শেষ করতে পারছে না সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চীনা কোম্পানিকে জমি বুঝিয়ে না দিলে মেগা প্রকল্পটিতে ঋণের সময় না বাড়ানোর কথা জানিয়েছে চীন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ পড়ছে প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু অবকাঠামো নির্মাণে খরচ প্রতি কিলোমিটারে ১৬১ কোটি টাকা। এই খরচ এটিকে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়কে পরিণত করছে। কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয়ে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই এক্সপ্রেসওয়ের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরপর আছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। র্যাম্পসহ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ ১৯১ কোটি টাকার বেশি।
দেশে চার লেন মহাসড়কের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে প্রায় ৭৭ কোটি ২২ লাখ টাকা (৬৬ লাখ ডলার), ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৮১ কোটি ৯০ লাখ টাকা (৭০ লাখ ডলার), ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ২৯ কোটি টাকা (২৫ লাখ ডলার) ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ ২৫ লাখ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। চার লেনের সড়ক তৈরিতে প্রতি কিলোমিটারে ভারতে ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়। চীনে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার।
নির্মাণ ব্যয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, এ ধরনের বড় প্রকল্পগুলোতে কী পরিমাণ ব্যয় হয়েছে বা হচ্ছে, তার পর্যালোচনা দরকার।
প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন-পরবর্তী মূল্যায়ন দরকার। কিন্তু এমন মূল্যায়ন হয় না। দেশে সমসাময়িক যত প্রকল্প হয়েছে, সেগুলোর সব ব্যয়বহুল। তাই এগুলোর সঙ্গে তুলনা না করাই উচিত; বরং সঠিক পর্যালোচনা করা এবং আশপাশের দেশগুলো থেকে ধারণা নিতে হবে।
সেসব দেশে একই মানের অবকাঠামোতে কী পরিমাণ খরচ হয় এবং বাংলাদেশে কী পরিমাণ খরচ হয়, সেগুলো দেখতে হবে। হাদিউজ্জামান বলেন, এখানে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ অবশ্যই আছে। এখানে অনেক কিছুই আমদানিনির্ভর। সেসব পরিবর্তন দরকার। যেমন দেশে সিমেন্ট উৎপাদনে ভালো করলেও বিটুমিন দিয়ে রাস্তা বানানো হচ্ছে। এগুলো এখন ভাবনার বিষয়। দেশে অনেক প্রকল্পে কাঁচামাল যেমন আমদানি করা হয়, পাশাপাশি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও বিদেশি। এতেও খরচ বাড়ে।
তবে ১৪ জুলাই তৎকালীন সড়কসচিব (পরে চুক্তি বাতিল) এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী নির্মাণ ব্যয়ের বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, খরচের বিষয়টি অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানে সমীক্ষা, নকশা, ভূমি অধিগ্রহণ—এসব অনেক বিষয় থাকে। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এটি বেশি খরচ নয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় চার বছরে নির্মাণকাজ শেষ করে আরও ২১ বছর রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে এসপিভি কোম্পানি। চার বছরে নির্মাণকাজ শেষ হলে এর ছয় মাস পর থেকে তারা টোল নিতে পারবে। ১০৭ কোটি টাকা করে ৪২টি কিস্তিতে টোল আদায় করবে চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল জটিলতা জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। এ কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি সওজ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চীনা কোম্পানিকে জমি বুঝিয়ে না দিলে এই মেগা প্রকল্পে ঋণের সময় না বাড়ানোর কথাও জানিয়েছে এসপিভি কোম্পানি। একই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ডলারের দাম বাড়ায় প্রকল্পের ভিত্তিমূল্য বাড়াতে বলেছে কোম্পানি।
রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, এসপিভি জানিয়েছে, কাজ শুরু না হওয়ায় তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের ১ হাজার ২১০ কোটি টাকার সহায়তা প্রকল্পের মূল প্রকল্পের অগ্রগতি এক-তৃতীয়াংশ। ইতিমধ্যে ৩৫৬ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশাবাদী।
এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ হবে এবং চীনা কোম্পানি জমি বুঝে পাবে।
সওজ বলছে, রামপুরা-ডেমরা সড়ক এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত হলে রামপুরা থেকে ডেমরা হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হবে। শিমরাইল মোড়ে একাধিক স্তরের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের যানবাহনের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত হবে।
তবে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, শহরের মধ্যে পিপিপি প্রকল্পের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সংযোগ সড়ক। মহাসড়ক থেকে ঢাকায় ঢোকার সময় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে বাস-গাড়ি আটকে থাকছে। এ সমস্যার সমাধান হলো সংযোগ সড়ক বা অরবিটাল রোড; যাতে যানবাহন শহরে ঢোকার আগেই এসব রোড ধরে গন্তব্যে চলে যেতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।