জুমবাংলা ডেস্ক: সুনীল অর্থনীতি বা Blue Economy অর্থনীতির এমন একটি বিষয় যেখানে একটি দেশের সামুদ্রিক পরিবেশ কিংবা সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষন নিয়ে আলোচনা করা হয়। সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্রের সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের বিভিন্ন প্রকার সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলোশিপ চালু করেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এই ফেলোশিপের জন্য অনেক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক আবেদন করেন। সকলের আবেদন পত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এম. আফজাল হোসেনকে তার ‘এক্সপ্লোরিং দ্যা পটেনশিয়াল সী-উইডস ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা প্রস্তাবনার জন্য এই ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্লু-ইকোনমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সেসব বিষয় নিয়ে ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো প্রফেসর ড. এম. আফজাল হোসেনের সাথে কথা বলেছেন জুমবাংলার নিজস্ব প্রতিবেদক কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল মান্নান।
প্রথম ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর আপনার অনুভুতি কেমন ছিল?
ড. এম. আফজাল: প্রথম ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো হতে পারাটা আমার জন্য ছিলো নিঃসন্দেহ অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের।জীবনের বেশিরভাগ সময় আমার কেটেছে শিক্ষা এবং গবেষণা নিয়ে।আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নিয়েছি ঠিকই কিন্তু এখনো গবেষণার কাজ বন্ধ হয়নি আমার। গবেষণা আমার ভীষণ পছন্দের একটি বিষয়। নিত্য নতুনত্ব খুঁজে পাওয়ার মধ্যে আমি আলাদা একটা তৃপ্তি খুঁজে পাই। ইউজিসি ফেলো হিসেবে বিগত এক বছর সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে কাজ করেছি এবং এটার উপর ইউজিসিতে আমি একটা প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। সেখানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. দিল আফরোজা বেগম সহ ইউজিসির অন্যান্য সদস্য ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, গবেষক এবং বেসরকারি সংস্থার প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন।তারা সকলেই আমার কাজের প্রশংসা করেছেন। এটি আমার আর একটি সফলতা বলে মনে করি। সত্তোরোর্ধ বয়সে এসে নতুন করে আন্তর্জাতিক জার্নালে এ বিষয়ে আমার একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
ইউজিসি ফেলো হিসেবে আপনার ১ বছর মেয়াদকাল পূর্ণ হয়েছে, এই ১ বছরে ব্লু-ইকোনমি নিয়ে আমরা কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন?
ড. এম. আফজাল হোসেন:‘এক্সপ্লোরিং দ্যা পটেনশিয়াল অভ সী-উইডস ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরচালনা করছি। আমরা অনেকেই ভেবে নিই সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে কি আর এমন কিছু হবে। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সী উইডে (শৈবাল) প্রচুর প্রোটিন আছে, যা ফিস ফিড হিসেবে আমদানি করা ফিস অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে। ৩ ধরণের সী-উইডের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার বা সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। আর লালটি হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর বাদামি সী-উইড খাবার ও হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন দুই কাজেই ব্যবহার হয়। হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন সাধারণত শিল্প উৎপাদনে জলীয় কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগে। কসমেটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এমন কিছু উপাদান পাওয়া যায় এমন সী-উইডও অনেক পাওয়া গেছে সমুদ্রে।
বাংলাদেশে সী-উইডস চাষ সম্প্রসারণে কি কি বাধা/চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন?
ড. এম.আফজাল হোসেন: বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবাল থেকে খাদ্যপণ্য, ঔষধিপণ্য, প্রসাধনী পণ্য, সার, বায়ো ফুয়েল ও পরিবেশ দূষণরোধক পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। খাদ্য হিসেবে নুডলস জাতীয় খাবার, স্যুপ জাতীয় খাবার, সবজি জাতীয় খাবার, শরবত, সল্টেস দুধ, সমুচা, সালাদ, চানাচুর, বিস্কুট, বার্গার, সিঙ্গেরা, জেলি, ক্যান্ডি, চকলেট, পেস্টি, ক্রিমচিজ, কাস্টার্ড, রুটি, পনির, ফিশফিড, পোলট্রিফিড, সামুদ্রিক সবজি এসব খাবার তৈরি ছাড়াও এগারএগার, কেরাজিনান, এলগ্যানিক এসিড, ক্যালসিয়াম মূল্যবান দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশে স্বল্প পরিসরে চাষাবাদ হলেও প্রসেসিং এবং বাজারজাতকরণে উদ্যোগী হবেন এমন সংখ্যা খুবই কম। যে কারণে অনেক সুযোগ থাকা স্বত্তেও আমরা সেটাকে কাজে লাগাতে পারছি না। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং প্রচারণা প্রয়োজন। সচেতনতা তৈরি হলে ভাত/প্রোটিনের বিকল্প হতে পারে এটি যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ব্লু ইকোনমি সম্প্রসারণে সরকারের কি করণীয় উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. এম.আফজাল হোসেন: ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ সরকারকে নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাত্ত ও সঠিক পরিসংখ্যান করে বিনিয়োগকারীদের এই খাতে কীভাবে আকৃষ্ট করা যায় এবং এই খাতের কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভরতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ সম্পর্কে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সবার আগে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সমন্বিত মেরিটাইম পলিসি বা সমুদ্র নীতি প্রণয়ণ করা। এর মাধ্যমে সমুদ্র নিরাপত্তা, সমুদ্র দূষণ, সমুদ্রের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ, সমুদ্রবিজ্ঞান ও গবেষণা, প্রযুক্তির সংযোজন, সমুদ্র পরিবেশ সুরক্ষা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের সামর্থ্য বাড়ানো এবং প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার পাশাপাশি বৈশ্বিক চাহিদার ভিত্তিতে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার ও প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্লু ইকোনমি কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. এম.আফজাল হোসেন: ব্লু- ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্রের সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। মৎস্যসম্পদের মাধ্যমে সমুদ্র খাবারের চাহিদা মেটায় এবং পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণীজ-অপ্রাণীজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জন করেছে। এর একটি হলো প্রাণিজ, অপরটি অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যাদি। বঙ্গোপসাগরের বিপুল পরিমাণ আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। এসব আগাছার মধ্যে ইসপিরুলিনা যা অত্যাধিক মূল্যবান। সমুদ্রে শুধু মাছ রয়েছে প্রায় ৫০০ প্রজাতির, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ২০ প্রজাতির কাকড়া ও ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে শ্যালফিশ ,অক্টোপাস, হাঙ্গরসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরো রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালু। যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সিমেন্ট বানানোর উপযোগী প্রচুর ক্লে রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে।
এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ সঠিকভাবে আহরণ করতে পারলে নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তা ছাড়া সামুদ্রিক মাছ থেকে খাবার, মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, সস, চিটোসান ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব, যার ফলে নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে দেশের জন্য প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।