জুমবাংলা ডেস্ক : প্রবাস জীবনে আপনজনদের কাছ থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে কষ্টের। দেশে থাকলে কাউকে দেখতে ইচ্ছে করলে চট করে গিয়ে দেখে আসা যায়। কিন্তু প্রবাসে ইচ্ছে থাকা সত্বেও সম্ভব হয় না এক মুহুর্তে চলে যাওয়া। মানুষ তখন টুকরো টুকরো স্মৃতি পসরার মতো সাজিয়ে এক একটা করে খুলে দেখে। তখন যেন মনের মধ্যে এক ফালি রোদ এসে পড়ে, যা কখনো মলিন হয় না। কখনও অস্ত যায় না। আর এটুকু না থাকলে মানুষ একদিনও দূরে থাকতে পারত না।
কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পছন্দমতো নিজের গন্তব্য বেছে নেয় ঠিকই, তা সত্বেও দেশের জন্য মন কেমন করে। মন তো চঞ্চলা হরিণীর মতো, যখন ছুটে তখন বাঁধন হারা ছুটতে থাকে। মাতৃভূমির টান মানুষ কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না। তবুও আবার মানিয়ে নেয় সময় পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে।
আমরা দেশে ফেরার জন্য যখন এয়ারপোর্টে যাই, তখন মানুষের উৎকণ্ঠা দেখে ভালো লাগে। বোর্ডিং পাস নেওয়া হলে তাড়াহুড়োর কিছু নেই, এটা সবাই জানে। এমনকি আপনি যদি সবশেষ যাত্রীও হোন– আপনার জন্য অপেক্ষা করবে। অ্যানাউন্স করবে। অতএব তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তা সত্বেও ভদ্রভাবেই নীরবে এক রকম ব্যস্ততা কাজ করে, যদি এক জনের আগে গিয়ে ফ্লাইটে ওঠা যায়।
যারা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় থাকে, তারাও নিঃসন্দেহে রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কিন্তু পার্থক্য তাদের কাজের ধরন। তাছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতা উঁচু লেভেলে হওয়ার কারণে জীবন যাত্রার মান উন্নতই থাকে। ভালো দেশে থাকার জন্য নাগরিক সকল সুবিধা ভোগ করায় তাদের মনে আলাদা একটা শক্তি থাকে। শ্রমের ন্যায্য পাওনা তারা পেয়ে যায় বিনে বাক্যে।
পক্ষান্তরে যারা মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, কোরিয়া– এসব দেশে থাকে, তাদের কথা আমাদের একটু আলাদা করেই ভাবা উচিৎ। কারণ তাদের একটা টাকা উপার্জনে শরীর থেকে দশ ফোটা ঘাম ঝরাতে হয়। শ্রমজীবী মানুষ। অসংখ্য মানুষ আছে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই কম। তবুও বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যায় বিদেশ বিভুঁইয়ে। তার উপর অনেকেই আছে যারা নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বাবা–মা ও পরিবার রেখে বিদেশে পাড়ি জমায়। তাদের নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। আমার কাছে মনে হয় তারাই প্রকৃত যোদ্ধা। তাদের আসমান জোড়া একটা মন আছে। তা না হলে কিছুতেই এতটা ত্যাগী হওয়া সম্ভব নয়। নিজে কোনো রকম থাকে অথচ নিরলসভাবে ভেবে যায় পরিবার–পরিজনের বিলাসী জীবনের কথা।
যখন ঢাকায় ছিলাম, চাকরির সুবাদে পাশের দেশগুলোয় কমবেশি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু তখন মনে হতো– ধ্যাৎ দেশে না ফিরতে পারলেই বুঝি ভালো হতো। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। ৫টা বাজলেই ঘরে ফেরার তাড়া– যে করেই হোক খুব দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে হবে। আমি কখনোই পছন্দ করতাম না সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকা। কিন্তু তাও বাসায় ফিরতে ফিরতে কখনও সন্ধ্যা হয়েও যেত। যেটা অপছন্দের ছিল। রাস্তার দুধারের লাইট জ্বলে উঠলে মনে হতো সব এক রকম। রাস্তাঘাট ঠাওরাতে আমার অসুবিধে হতো। যা হোক যেহেতু প্রবাস নিয়ে লেখার কথা তো কিছু ক্ষণের জন্য শেকড়ের কথা না হয় ভুলে যাই।
আমি যখন প্রথম আমেরিকায় পাড়ি জমাই, লম্বা সময় ধরে ফ্লাই করছিলাম। তাও এতটুকু ক্লান্ত লাগেনি। তবে মন খারাপ যে কিছু মাত্র ছিল না, তাও বলব না। মায়ের জন্য মন বার বার কেঁদে উঠছিল, তখন কান্না পেয়েছে আবার নিজেকে সংযত করেছি। ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক, নিউইয়র্ক থেকে আবার মায়ামি– তখন একটু অবসাদ বোধ করছিলাম। মায়ামি দিন পনের থাকার পর যখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া এলাম, সেই তখনই আমার মন খারাপ হতে শুরু করে। প্রথম অনুভব হলো আমি প্রবাসী হয়ে গেলাম। চাইলেও যখন তখন উড়াল দিতে পারব না– দেশে এত দূরের রাস্তা! মায়ের সঙ্গে কথা বলতাম প্রতিদিন। তাতেও মন ভরত না। এক বিশাল শূন্যতা অনুবভব করতাম।
যেমন দূরের মরুদ্যান বুকে নিয়ে খা খা শূন্যতা নিয়ে নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ঠিক তেমনটি অনুভব করতাম। আমার বর বাংলা বোঝে না, কিন্তু বুঝতে পারত আমার মন খারাপ। মন খারাপ দেখে বলতো, ‘আমি যখন তোমার দেশে গিয়েছিলাম, তখন আমারও তোমার মতো মন খারাপ হয়েছিল। খুব করে বাবাকে মিস করেছি। তাই তোমার ব্যাপারটাও বুঝি। কিন্ত কি করব বল। তুমি আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে। অনেক বড় শহর থেকে ছোট একটা শহরে এসেছো তাই এখানকার পরিবেশ মানিয়ে নিতে খানিকটা সময় লাগবে।’
তখন ভাবতাম সময় লাগলেও যেন মানিয়ে নিতে পারি। সেটাই ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ সময়ের পর মানিয়ে নিয়েছি বটে। তারপরও যখন দেশে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা থাকে। মনে হয় যেন দিন ফুরোতে চায় না। আসলে আমরা যত দূরেই থাকি না কেন, দেশ ও দেশের মাটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী কবি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।