যিকরু হাবিবীল ওয়াহেদ : করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হলো ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। তাছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া দেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতিসহ বিবিধ কারণে মানুষ এমনিতেই বহুবিধ কষ্টে আছে। এর ওপর যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।
তাছাড়া আর সপ্তাহ দুই পরেই রহমত-মাগফেরাত-নাজাতের বার্তাবাহক মাস পবিত্র রমজান। মুসলমানদের কাছে রমজানের বিশেষত্ব অসীম। বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের লাগামহীনতার কথা। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বারংবার উঠে এসছে এসব প্রতিবেদনে।
এত এত সংবাদের পরও সিন্ডিকেট ভাঙা তো দূরে থাক, বরঞ্চ সিন্ডিকেট যেন দিন দিন বটগাছে রূপ নিচ্ছে। একদিকে সাধারণ মানুষের হা-হুতাশ বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষও বাড়ছে সমানে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে শুধুই অসাধু সিন্ডিকেটগুলো।
আওয়ামী লীগের সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে পেরেছিল। তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টও ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে আজ অবধি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে বাড়া শুরু হয়েছে, তা যেন আর থামছেই না। তাছাড়া বাজার মনিটরিং এ ঢিলেঢালা ভাব বা নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, তেলসহ ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম আগের দাম থেকে বেড়ে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্যের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সরকার গঠনের বছর দুয়েক পর থেকে ২০২৩ সাল ডিসেম্বর পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক মানুষের সহজ সাবলীল সুন্দর জীবন যাপনের প্রতি। কিন্তু একটি অসাধু চক্র বারংবার সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায়। এই কাজে অসাধু চক্রটিকে অধিকাংশে সফলও বলা চলে।
তাই সরকারের উচিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই চক্রটির মূলোৎপাটন করে শিকড় উপড়ে ফেলা। বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং সংবাদ মাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, যে চিকন চালের দাম ২০০৯ সালে প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা ছিল, সে চালের দাম বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫-৯০ টাকা। মোটা চালের দাম ছিল ২২-২৩ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে ৫৫-৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ডালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মোটা মসুর ডালের দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ১০০-১১০ টাকা। চিকন মসুর ডালের দাম ছিল ২০০৯ সালে ৭০-৮০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০-১৫০ টাকা। ২০০৯ সালে মুগ ডালের দাম ছিল ৮৫-১০০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৫-১৭০ টাকা।
২০০৯ সালে এক কেজি আটার দাম ছিল ২৭-২৯ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি ময়দার দাম ছিল ৩৫-৩৭ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫-৭০ টাকা। পেঁয়াজ- ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৪৪ টাকা, বর্তমানে বেড়ে সে পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮-৩৪ টাকা, বর্তমানে সে পেঁয়াজের দাম বেড়ে ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এরপরও মাঝেমধ্যে পেঁয়াজের বাজার অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এক কেজি রসুনের দাম ছিল ৮০-৮৫ টাকা। বর্তমান বাজারে তা বেড়ে কেজি ২১০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা, বর্তমানে সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। যদিও সরকার বলছে কেজি ১৬৮ টাকার ওপরে যারা দাম নিবে সেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চিনি- ২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা, বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়।
ডিম-২০০৯ সালে দেশি মুরগির ডিম হালি ছিল ৩২-৩৪ টাকা, সেটা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৫-২৬ টাকা, বর্তমানে হালি ৪০-৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গরুর মাংস- গরুর মাংসের কেজিপ্রতি ২০০৯ সালে দাম ছিল ২২০-২৩০ টাকা, বর্তমানে প্রতি কেজি (হাড়সহ মাংস) বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়। আর হাড়ছাড়া প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮৫০-৯০০ টাকায়। গরুর মাংস এখন অঘোষিতভাবে অনেকটা ওপরতলার মানুষদের খাবার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এখন মেজবান কিংবা অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেতে পান। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ সবার কমন সবজি হিসেবে যে খাবার বিবেচিত সেই আলুর দামও কয়েকগুণ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকায়। তবে কিছুদিন পর পর আলুর দামও বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে।
শীতের মৌসুমকে বলা হয় সবজির মৌসুম। অথচ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে শাক সবজিসহ উৎপাদনশীল প্রতিটি পণের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। অথচ উৎপাদনকারী কৃষক তাদের ন্যায্যমূল্য থেকে সর্বদা বঞ্চিত হয়ে আসছে। সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেশ তৎপর।
এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা তেমন চোখে পড়ে না। তার ওপর বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল/সিলিন্ডার খরচ, গাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ বিভিন্ন সেবা প্রাত্যহিক নানা খরচসহ জীবন যাপন সংশ্লিষ্ট সকল খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ।
আগে যেখানে ২০-২৫ হাজার টাকা বেতনের একজন চাকরিজীবি টেনেটুনে সংসার চালাতে পারতেন, এখন উল্টো ৫-১০ হাজার টাকা প্রতিমাসে লোন হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক কলহ বাড়ছে। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক সামাজিক চেইন।
/ কলামিস্ট | সংগঠক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।