ধাক্কার গতি বেশি, নাকি আলোর গতি বেশি? পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ বিষয়গুলো আমরা মোটামুটি ভালোই বুঝি—অন্তত এমনটাই আমাদের মনে হয়। জটিলতা বললেই আমরা বুঝি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত জগতের কথা। যেখানে উপপারমাণবিক কণারা একই সঙ্গে তরঙ্গের মতোও আচরণ করে।
কিংবা আপেক্ষিকতার কল্যাণে যখন সময় প্রসারিত হয়, সংকুচিত হয় বস্তু বা পথের দৈর্ঘ্য—তখন মনে হয়, স্বাভাবিক জ্ঞান বা কমনসেন্সের সঙ্গে মিলছে না। ওসব অদ্ভুত জিনিস বাদ দিলে—তত্ত্বকথার নিগুঢ় বিষয়গুলো না বুঝলেও—আমাদের মনে হয়, বাস্তব দুনিয়ার কাজকর্ম আমরা ভালোই বুঝি। এমনটাই যদি আপনার ধারণা হয়, তাহলে ওপরের প্রশ্নটা আপনার জন্যই। প্রশ্নটাকে আরেকটু সবিস্তারে বলি, দাঁড়ান।
ধরুন, একটা বিশাল লোহা বা ইস্পাতের দণ্ড। কিংবা রড। অনেক লম্বা। এর এক প্রান্তে আপনি ধাক্কা বা নাড়া দিলেন। ওপাশে দাঁড়ানো দর্শক ওই প্রান্তটাকে নড়তে দেখবেন শিগগিরই, এটুকু আমরা সবাই জানি। প্রশ্ন হলো, অন্য প্রান্তটা নড়তে ঠিক কতক্ষণ লাগবে?
উত্তরটা, বলা বাহুল্য, বৈজ্ঞানিক হওয়া চাই। অর্থাৎ ‘এই তো, অল্প সময়’ বা ‘তাৎক্ষণিক’—এভাবে বললে হবে না। উত্তরটা আপনি মাথায় তৈরি করতে থাকুন, তবে তার আগে সমস্যাটার গভীরতাটা একটু বুঝে নিন।
আপনার কাছে যে দণ্ডটা আছে, ধরুন ওটার দৈর্ঘ্য ৩ লাখ কিলোমিটার। আলো ১ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে, জানেন নিশ্চয়ই। এইটুকু দূরত্বকে তাই ১ আলোকসেকেন্ড বলা যায়। তাহলে প্রশ্নটা হলো: ১ আলোকসেকেন্ড দীর্ঘ একটা দণ্ডের এ প্রান্তে ধাক্কা দিলে ও প্রান্তটা নড়তে কত সময় লাগবে? অর্থাৎ সিগন্যালটা কত দ্রুত যাবে?
উত্তরটা দিতে পারেন দুই ধাপে। প্রথম ধাপের অপশনগুলো হলো:
ক. আলোর চেয়ে কম বেগে (অর্থাৎ, ১ সেকেন্ডের কম সময় লাগবে)
খ. আলোর বেগে (অর্থাৎ, ১ সেকেন্ড লাগবে)
গ. আলোর চেয়ে ধীরে (অর্থাৎ, ১ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে)
উত্তর যদি ক হয়, তাহলে বুঝতেই পারছেন, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো আলোর চেয়ে দ্রুত বেগে সত্যিই যোগাযোগ বা সিগন্যাল আদানপ্রদান সম্ভব হয়ে যাবে।
এবারে দ্বিতীয় ধাপ: উত্তর যদি ‘গ’ হয়, তাহলে কীসের বেগে সিগন্যালটা চলবে, বলতে হবে সেটা। এ ক্ষেত্রে সিগন্যালের বেগ পরিবাহিত হতে পারে দুইভাবে।
ঘ. দণ্ডের দৈর্ঘ্য / শব্দের বেগ—অর্থাৎ সিগন্যাল ছুটে যাবে শব্দের বেগে। শব্দের বেগের কথা বলার কারণ, সিগন্যাল বয়ে নেওয়ার মূল কাজটা যদি করে দণ্ডটির উপাদান; সে ক্ষেত্রে উপাদানের অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করবে শব্দের বেগে। তখন সময় লাগবে ১৬ ঘণ্টা!
ঙ. সিগন্যাল কত পরে শোনা যাবে, তা নির্ভর করতে পারে কত জোরে আঘাত করা হয়েছে, তার ওপর। এ ক্ষেত্রে দণ্ডের দৈর্ঘ্যকে আঘাতের বেগ দিয়ে ভাগ করতে হবে, তারপর ভাগফলকে গুণ করতে হবে ইয়েল্ড স্ট্রেইন বা ইয়েল্ড স্ট্রেংথ নামে একটা জিনিস দিয়ে। খুব সহজ করে এই জিনিসটাকে বলা যায় ইলাস্টিসিটি—অর্থাৎ কতটা ধাক্কা সহ্য করতে পারবে দণ্ডটা। মানে, এটুকু ধাক্কা দিয়ে দণ্ডটাকে বাঁকালেও সেটা আবার নিজের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে; এরচেয়ে বেশি শক্তি দিয়ে দণ্ডটাকে বাঁকালে ওটা বেঁকে যাবে, আর আগের অবস্থায় ফিরবে না।
উত্তরটা কী হতে পারে, অনুমান করেছেন? না করলেও সমস্যা নেই। করলে, উত্তর মিলে গেলে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতেই পারেন। ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট ব্রায়ান হেইডেট তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে প্রশ্নটির বিস্তারিত জবাব দিয়েছেন। আমরা এখানে সংক্ষেপে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি।
যেকোনো ধাতব দণ্ড আমাদের কাছে খালি চোখে মনে হয়—একদম ভরাট। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সলিড’। বাস্তবে বিষয়টা তা নয়। দীর্ঘ এই ভরাট কাঠামোর গভীরে উঁকি দিলে দেখব, জিনিসটা আসলে একধরনের স্ফটিকের মতো কাঠামো—অণুর দল মিলেমিশে এই অবকাঠামো তৈরি করেছে। আমরা জানি, ধাতব কাঠামোতে সাধারণত শেষ কক্ষপথের ইলেকট্রনগুলো আলাদা হয়ে যায়, ফলে ধাতব মৌলগুলো পরিণত হয় আয়নে। ইলেকট্রনগুলো এই আয়নিত গঠন-কাঠামোর চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে কাঠামোটা শক্ত থাকে, দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে।
এখন, এই ধাতব দণ্ডের একপাশে ধাক্কা দিলে বিষয়টা কী হবে? প্রথমে একসারি অণু ধাক্কা খাবে, সেগুলো ধাক্কা দেবে পরের সারির অণুগুলোকে। ফলে ধাতব দণ্ডের মধ্য দিয়ে এই ধাক্কা তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়বে, শব্দের বেগে। শব্দের বেগ নির্ভর করে মাধ্যমের ঘনত্বের ওপর। পৃথিবীতে পানিতে শব্দের বেগ সেকেন্ডে দেড় হাজার মিটার, বাতাসে ৩৪০ মিটার। কিন্তু সলিড বা কঠিন পদার্থে শব্দের বেগ অনেক বেশি—কত বেশি বা ঠিক কত হবে, তা নির্ভর করবে ধাতব দণ্ডের উপাদান বা মাধ্যমের ওপর।
কাজেই, যাঁরা উত্তর ‘ঘ’ অনুমান করেছিলেন, আপনাদের অভিনন্দন! বাকিদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পদার্থবিজ্ঞানের জগৎটি—বলা উচিৎ, আমাদের চারপাশের বিশ্বটা অনেক চমৎকার।
অন্য উত্তরগুলো—বিশেষ করে ‘ক’ আর ‘খ’ কেন সঠিক নয়; তা আশা করি সবাই বুঝেছেন। তবু সংক্ষেপে যদি বলি—উপাদানের মধ্য দিয়ে তরঙ্গ প্রবাহিত যখন হবে, এই উপাদানের ভর আছে, ভর শূন্য নয়; কাজেই এগুলোর মধ্য দিয়ে আলোর বেগে তরঙ্গ প্রবাহিত হতে পারবে না। যদি হয়, তবে—কোনোরকম সমীকরণের মধ্যে না গিয়েই বলা যায়—দণ্ডটির ভর হয়ে যাবে অসীম, দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়ে হবে অসংজ্ঞায়িত (শূন্য দিয়ে ভাগ আকারে চলে আসবে সমীকরণে)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।