বৃহস্পতির কোনো কঠিন পৃষ্ঠতল নেই। পুরোটাই একটা গ্যাসপিণ্ড। মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসে পরিপূর্ণ গ্রহটি। অর্থাৎ, বৃহস্পতিতে অবতরণ করা আর পৃথিবীতে মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একই কথা। বৃহস্পতিতে কোনো স্থল না থাকলে মানুষ নামবে কোথায়? চলুন, সেটাই কল্পনা করা যাক। তবে এই কল্পনাটি আমরা করব যৌক্তিক তথ্যের ভিত্তিতে।
বর্তমানে যে ধরনের স্পেসস্যুট পরে নভোচারীরা মহাকাশে যান, সেরকম স্পেসস্যুট নিয়ে বৃহস্পতিতে যাওয়া যাবে না। তাহলে অ্যাডভেঞ্চার শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে। কারণ, বৃহস্পতি থেকে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার দূরে থাকতেই উচ্চশক্তির কণা বিকিরণের তোপে আপনার মৃত্যু ঘটবে।
কিন্তু আমরা এখনই হতাশ হতে রাজি নই। যেতে চাই বৃহস্পতির ভেতরে। ধরুন, আমরা এমন একটা স্পেসস্যুট বানালাম, যেটা আমাদের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাঁচাতে সক্ষম। আরও একটা কথা জানিয়ে রাখি। বৃহস্পতিতে কোনো অক্সিজেন নেই। তাই আমাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। এ সব শর্ত মেনেই যাত্রা শুরু করলাম। এখন কী হবে?
যাত্রা শুরুর পর বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে ঘন্টায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার বেগে নামবেন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে বেগে নামা যায়, এখানে বেগ তার চেয়ে অনেকটা বেশি। কারণ, বৃহস্পতির মধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। যাহোক, বৃহস্পতিতে নামতে থাকলেন। ২৫০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আপনার চোখে পড়বে অ্যামোনিয়ার মেঘ। সেখানে তাপমাত্রা থাকবে মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃহস্পতির বাতাস অনেক শক্তিশালী। গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ৪৮২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এই গতিতে বাতাস আপনার গায়ে আঘাত করলে মনে হতে পারে, আপনি কোনো দানবাকৃতির টর্নেডোর মধ্যে আছেন। কারণ, বৃহস্পতি সৌরজগতের সবচেয়ে দ্রুততম ঘূর্ণায়মান গ্রহ। বৃহস্পতির এক দিন পৃথিবীর প্রায় ৯ দশমিক ৫ ঘন্টার সমান। এদিকে, যত নামছেন, আপনার ত্বরণ হচ্ছে, সে কথাটাও ভুলে যাওয়া চলবে না। তারমানে, বাড়ছে আপনার নামার বেগ।
এবারে চলুন, বৃহস্পতির আরও ১২০ কিলোমিটার নিচে যাই। এখন পর্যন্ত মানুষ এই গভীরতা পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে পেরেছে। (একদম সঠিক সংখ্যাটি হলো, ১২৪ কিলোমিটার।) ১৯৯৫ সালে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ধ্বংস হওয়ার আগে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পাঠানো গ্যালিলিও প্রোব এই গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে মাত্র ৫৮ মিনিট টিকে ছিল প্রোবটি। তারপর শেষ!
এরপর যত নামবেন, তত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবেন। একসময় আপনার চারপাশে একমাত্র আলোর উৎস হবে বজ্রপাত। আর বাড়তে থাকবে তাপমাত্রা। পাশাপাশি পৃথিবীর তুলনায় এক হাজার গুণেরও বেশি চাপ অনুভব করবেন। এ অবস্থায় বেঁচে থাকতে হলে আপনার স্পেসস্যুটটি হতে হবে টেরিসেট সাবমেরিনের মতো।
এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম সাবমেরিন। এই যে আপনি বৃহস্পতির নিচে নামলেন, এতে প্রায় ১২ ঘন্টা কেটে গেছে। পৃথিবীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কারণ, বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডল রেডিও তরঙ্গ শোষণ করে নেয়। এ অবস্থায় আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়। এখান থেকে আরও নিচে নামলে তাপমাত্রা ও চাপ বাড়তেই থাকবে।
বৃহস্পতির আরও গভীরে প্রবেশ করলে মনে হবে আপনি সাঁতার কাটছেন। অবশ্য এ অবস্থায় যদি আপনি বেঁচে থাকেন আরকি! ধরে, নিচ্ছি আপনি এখনো বেঁচে আছেন। তাহলে এখানে আপনি সুপার ক্রিটিক্যাল ফ্লুইড-এর দেখা পাবেন। কোনো পদার্থ সম্পূর্ণ তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় না থাকলে সেই অবস্থাকে বলে সুপার ক্রিটিক্যাল ফ্লুইড। আরও সহজভাবে বললে, যে অবস্থায় তরল ও গ্যাস সহাবস্থান করে, সেটাই সুপার ক্রিটিক্যাল ফ্লুইড।
যাহোক, এর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় তাপমাত্রা আরও উষ্ণ হতে থাকবে। অবশেষে, এটি সূর্যের পৃষ্ঠের সমতূল্য হয়ে যাবে! সঙ্গে পৃথিবীর চেয়ে ২০ লাখ গুণ বেশি চাপ তো আছেই। এ অবস্থায় আপনার চারপাশের হাইড্রোজেনের বন্ধন পরিবর্তন হয়ে তৈরি হবে ‘ধাতব হাইড্রোজেন’ (হাইড্রোজেনের একধরনের দশা)। এখান থেকে আপনি আর বের হতে পারবেন না।
আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি। ধাতব হাইড্রোজেন খুবই রিফ্লেক্টিভ (প্রতিফলক তল হিসেবে বেশ ভালো)। এটা শিলার মতো ঘন। আপনি আরও গভীরে ভ্রমণ করতে চাইলে ধাতব হাইড্রোজেন থেকে আসা প্লবতা বল অভিকর্ষের নিম্নগামী টানকে প্রতিহত করবে। সেই প্লবতা আপনাকে ওপরের দিকে ধাক্কা দেবে। অনেকটা ইয়ো ইয়োর মতো। এ দুই বিপরীত শক্তি সমান হলে আপনি বৃহস্পতিতে মুক্ত অবস্থায় ভাসতে থাকবেন৷ ওপরে বা নিচে যেতে পারবেন না। আর, পালানোর তো কোনো সুযোগই নেই!
অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, বৃহস্পতির বিপুল চাপের কারণে এর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কঠিন পদার্থ থাকতে পারে। এসব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করেও যদি আপনি কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন, তাহলে হয়তো বায়ুমণ্ডলীয় চাপের মধ্যে আটকে যাবেন। তাই বলাই যায়, আপনার এই অভিযান মোটেও সুখকর হবে না।
বৃহস্পতির ভেতরটা এখনও আমাদের কাছে রহস্যময়। বৃহস্পতির বুকে অবতরণ করে সেখানে ঘোরাফেরা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরও উন্নতি হলে বৃহস্পতির রহস্য উন্মোচন হবে। তবে বাস্তবে যাওয়া সম্ভব না হলেও কল্পনার ফানুস উড়িয়ে বৃহস্পতিতে অভিযান তো করাই যায়, নাকি?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।