ধামরাইয়ের সাইট্টা গ্রামে দেখা মিলবে বট-পাকুড়ের মিলন, মহিষের গাড়ি

news_210057_2ট্রাভেল ডেস্ক : ভ্রমণ সংগঠন ‘দে-ছুট’-এর বন্ধুরা ঘুরতে গিয়েছিলাম ঢাকার পাশেই ধামরাই উপজেলার সাইট্টা গ্রামে। দিনটি ছিল শুক্রবার। যানজটের কারণে নবীনগর পর্যন্ত ঠেলেঠুলে গাড়ি চলে। এরপর একটানে ঢুলিভিটা হয়ে ধানতাঁরা। মাঝে জুমা নামাজের বিরতি। ধানতাঁরা থেকে বামে মোড় নিয়ে গাড়ি যখন ছোটে সাইট্টার পথে, তখন মনে হয় এ যেন এক প্রশান্তির পথ বাংলার সেই চিরচেনা সুনসান নিরিবিলি গাঁয়ের পথ। সবুজ প্রান্তর-গাছের ছায়া, পাখির কলতান শুনতে শুনতে এগিয়ে যাই সাইট্টা। দূর থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে যখন বটগাছ চোখে পড়ে, তখন কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়ি। কেউ একজন মন্তব্যই করে ফেলল, এ তো দেখছি গাবগাছের পাতার মতো। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।

পিচঢালা পথ ছেড়ে গাড়ি ঢোকে মেঠোপথে। থামে গিয়ে একেবারে বটবৃক্ষের ছায়াতলে। আনন্দে মন নেচে ওঠে। ওয়াও! চোখ ঠেকে কপালে। অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে রই। একি আসলেই বটবৃক্ষ নাকি ভিন্ন কিছু। ডালপালা ছড়িয়ে এখন মহীরুহ। নানা জায়গায় ঘুরতে গিয়ে জীবনে অনেক বটগাছের ছায়ায় বসার সুযোগ এসেছে, কিন্তু এ রকম আর কোনো বটগাছ আমার চোখে পড়েনি। আশ্চর্য সুন্দর সাইট্টা বটগাছের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ সুখী মনে হলো। ভালো করে পরখ করতে থাকি। গাছের ওপর থেকে বটের ঝুরি মানে শাখামূল ঝোলে। মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে এমন এক অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছে, যার বর্ণনা দিয়ে পাঠকদের বোঝানোর মতো সাধ্য নেই আমার, যা শুধু নিজ চক্ষেই দেখে অনুভব করা যাবে। এ রকম একটি বটগাছের সান্নিধ্যে সবাই বেশ আনন্দিত। ছবির ছৈয়ালরাও বেশ ব্যস্ত। ক্যামেরার শাটারে শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ। উচ্ছ্বসিত না হয়ে উপায় আছে! একটি বটগাছ একটি জীবন্ত ইতিহাস। সে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল আজকে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের দামালরাও। গাছের আদ্যোপান্ত জানতে এবার স্থানীয়দের খোঁজে নামি। দু-একজনের সঙ্গে ভাব জমাই। কিন্তু তথ্যসূত্র নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। এদিকে পেটেও টান পড়েছে। ইচ্ছে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাত-ভর্তা খাব, কিন্তু সময়ের আবর্তনে তা বিবর্ণ হয়ে সাইট্টা বটগাছের তলায় এসে ঠেকেছে। সব দোষ যানজটের। শহর-মহাসড়কের জ্যাম বর্তমানে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মহাযন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। সময় মিলিয়ে এখন আর কিছুই করা যায় না।

downloadএদিকে এ গ্রামের ধারেকাছে কোনো খাবারের হোটেলও নেই। ভাগ্য ভালো গাড়িতে হাঁড়ি-পাতিল ছিল। করিতকর্মা ফারুক বাইকে চড়ে স্থানীয় বাজার থেকে চাল-ডাল-ডিম কিনে আনে। গ্রাম্য চা দোকানি সন্তোষের সহযোগিতায় শুরু হয় রান্নার মহাযজ্ঞ। সে সুযোগে ঘুরে বেড়াই পুরো গ্রাম। ঘুরতে আর জানতে গিয়ে চোখে ধরা দেয় সাইট্টা গ্রামের নানা রূপ। জমির পর জমি লেবুবাগান। থোকায় থোকায় ধরে আছে নানা জাতের লেবু। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হাঁটু জলের ছোট নদী। সে নদীতেই জেলে ধরে মাছ। গাছের ডালে নানা রঙের পাখি। জনমানবের কোলাহল নেই। পাখিরা নিশ্চিন্ত মনে গেয়ে যায় গান। যেন সাইট্টা গ্রামটি ওদের জন্য অভয়াশ্রম। ভর সন্ধ্যায় রান্না শেষ। মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে খাবার জোটে ধোঁয়া তোলা খিচুড়ি আর ডিম ভুনা। আহ্ কী মজার স্বাদ!

খেতে খেতেই পরিচয় হয় জনি দাস নামের এক তরুণের সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল বেশকিছু তথ্য। সাইট্টা গ্রামটি ধামরাই উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ষাটটি পরিবার নিয়ে প্রথম এ গ্রামে বসতি শুরু। সে থেকেই এ গ্রামের নাম ষাটটি থেকে সাইট্টা হয়েছে। গ্রামে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০০। ৯৯ শতাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। শিক্ষার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। পেশায় অধিকাংশই সরকারি ও বেসরকারি চাকুরে। ধারণা করা যায়, গ্রামবাসীরা মানসিকতায় বন্ধুবৎসল। বটগাছটি সম্পর্কে জানালেন, এটির বয়স আনুমানিক ৫০০ বছর।

যদিও সুনির্দিষ্ট করে কেউ জানাতে পারেননি। তবু অন্তত ৪০০ বছরের কম নয়। বটগাছটির পাশেই পাকুড় গাছ। দুটি গাছ সময়ের আবর্তনে একটির সঙ্গে অন্যটির ডালপালা জড়িয়ে এখন বিরাট দৈত্যাকারের রূপ ধারণ করেছে। গাছটি প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। বটগাছ ঘিরে ভুতুড়ে কিছু কল্পকাহিনী লোকমুখে চালু রয়েছে। ফলে এর ডালপালা-ঝুরি না কাটা বা ছাঁটা হওয়ায় এখন এক বিশাল দৈত্যাকার রূপ ধারণ করেছে। গাছটির পাশেই একটি নাট মন্দির। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলে। নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। নীরব নিস্তব্ধ গ্রাম্য পরিবেশে শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব বারবিকিউ। বটগাছের তলায় কয়লার আগুনে মাংস ঝলসানো আহ্ সেই রকম একটা অনুভূতি। রাত ৯টায় সব আয়োজনের ইতি টেনে শিয়াল পণ্ডিতদের হুক্কাহুয়া আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরি।

কীভাবে যাবেন

ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী গাবতলী ও উত্তরার থার্ড ফেস এবং আব্দুল্লাহপুর হয়ে ধামরাই উপজেলার ধানতাঁরা বা কালামপুর বাজার হয়ে সাইট্টা গ্রামে যাওয়া যাবে।

পরিবহন: নিজস্ব বা রেন্ট কার নিয়ে গেলে সুবিধা বেশি হবে। তবে গুলিস্তান থেকে ধামরাইয়ের বাসে ঢুলিভিটা বাসস্ট্যান্ড বা কালামপুর বাজার। সেখান থেকে অটো বা ভ্যানে চেপে সাইট্টা। বাসে কালামপুর হয়ে গেলে সময় বেশ কম লাগবে।

ঘোরার সময়: সকাল সকাল সাইট্টা গ্রামের পথে বের হওয়াটাই মোক্ষম সময়।

Write a Comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *