ফেরদাউস আরা বেগম : ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কারণ হয়তো একটাই যে আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের এ লাইসেন্স পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সময় এবং খরচ দুটোই একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে যথেষ্ট বেশি। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে পদ্ধতিগত জটিলতাও যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেয়। একজন সেবা প্রদানকারী বা উৎপাদনকারীকে আরো অনেক ধরনের লাইসেন্স/অনুমোদন/সার্টিফিকেট/পারমিট/এনওসি গ্রহণ করতে হয়, ট্রেড লাইসেন্স হলো কেবল একটি প্রাথমিক লাইসেন্স। তাই এ লাইসেন্স যত দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক হবে ততই তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে তৎপর হতে এবং নতুন উদ্যোগ শুরু করতে পারবেন। সংগত কারণেই বিনিয়োগের প্রাথমিক স্তরেই একজন উদ্যোক্তা যাতে নিরুৎসাহিত না হন সে ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া দরকার।
ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তির সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ বিভিন্ন রকম। এর মধ্যে রয়েছে—আয়কর (নবায়নের ক্ষেত্রে), সাইনবোর্ড খরচ, লাইসেন্স ফি, ভ্যাট, লাইসেন্স বইয়ের দাম, আবেদন ফরমের মূল্য ইত্যাদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার স্থানীয় কর অর্থাৎ যে জায়গায় লাইসেন্স নিতে যাচ্ছেন সে জায়গায় ফ্যাক্টরি বা দোকান অথবা কোনো স্থাপনা করতে চাইলে সে স্থানের অনুমোদন বাবদ খরচ। এ সবকিছু মিলে একজন উদ্যোক্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা স্থাপনে বেশ দুর্ভোগের শিকার হয়ে থাকেন। বাস্তবিক অর্থে এ লাইসেন্স তাৎক্ষণিক হওয়া বরং প্রয়োজন। যাতে উদ্যোক্তা দ্রুত অন্য পদ্ধতিগুলো শুরু এবং দ্রুত বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদ্য বের হওয়া গ্র্যাজুয়েট বা এমবিএ বেঁচে থাকার মতো রোজগারের পথ হিসেবে একটি যথোপযুক্ত চাকরি বর্তমানে প্রায় অসম্ভব, তাই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়ে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটি ভালো উদ্যোগ নিতে যত দ্রুত রেগুলেটরি বাধাগুলো পার করতে পারেন ততই শ্রেয়।
আমরা দেখেছি, সিঙ্গাপুরে সম্পূর্ণ অনলাইনে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করা যায় মাত্র ২০ মিনিটে, মালয়েশিয়ায় ট্রেড নেম, ব্যক্তিনাম, ব্র্যাঞ্চ ইত্যাদি সবকিছুই হয় অনলাইনে। বাংলাদেশে কিছু কিছু সিটি করপোরেশন/মিউনিসিপ্যালিটিতে অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার চেষ্টা হলেও প্রকৃত বাস্তবায়ন তেমন নেই। এ ব্যাপারে একটি সময়সীমা নির্ধারণপূর্বক সেবাগুলো তাৎক্ষণিক প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
এরইমধ্যে বেসরকারি খাতের প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত/নির্ধারিত আবেদনপত্র এবং চেকলিস্টের জন্য সিটি করপোরেশন-১, স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে পত্র জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদ) ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু পদ্ধতি সহজীকরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনে আগ্রহী হবে।
এছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি লাইসেন্স ইস্যু এবং নবায়নের ক্ষেত্রে এবং এ-সংক্রান্ত কর ও ভ্যাট আহরণের ব্যাপারে সরকার একমত হয়েছেন, যা আর একটি ভালো উদোগ। তবে এ সুযোগগুলো হয়তো বড় উদ্যোগকে বেশি সহায়তা করবে, বাংলাদেশে প্রায় ৯০ শতাংশ উদ্যোগ কুটির, মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র। তাই এরা যাতে সময়মতো লাইসেন্সটি পেতে এবং নবায়ন করতে পারেন সে ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। উল্লেখ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা এবং যেকোনো সরকারি সুযোগ পেতে হলে এ লাইসেন্স বিশেষভাবে দরকার। কিছু কিছু শিল্প খাত এ লাইসেন্স না পাওয়ার কারণে দীর্ঘদিন থেকে সমস্যার মধ্যে রয়েছে।
প্লাস্টিক শিল্প এমন একটি খাত যেখানে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে অবশ্য সংগত কারণেই লাইসেন্স পাচ্ছেন না। ২০১৯ সাল থেকে ১ হাজার ৮৫০-এর বেশি প্লাস্টিক এবং কেমিক্যাল শিল্প-কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন হচ্ছে না। এর ফলে সরকার একদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তারাও স্বাভাবিক ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আবার বিনা লাইসেন্সে ব্যবসা পরিচালনায় একদিকে ব্যবসায়িক অসুবিধার পাশাপাশি পরিবেশ এবং জানমালের জন্যও হুমকিস্বরূপ। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং অনুমোদন প্রাপ্তিসাপেক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্সধারীদের জন্য নবায়ন কার্যক্রম বা সময়ানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এজন্য দরকার প্লাস্টিক এবং কেমিক্যাল শিল্পনগরীর কাজ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা। যত দিন পর্যন্ত পুরান ঢাকায় অবস্থিত এ শিল্প-কারখানাগুলো শিল্পনগরীতে স্থানান্তর না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত কমপ্লায়েন্স মেনে চলা কারখানাগুলোকে অ্যাডহক বেসিসে লাইসেন্স প্রদান করে সহজে ব্যবসা করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, এজেন্সি, ডিপার্টমেন্ট যৌথভাবে কাজ করে এ বিষয়ের সমাধান দরকার।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় সরকার কর্তৃক জারীকৃত ট্রেড লাইসেন্স এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক একটি লাইসেন্স। যে কারণে একটি ব্যবসায়িক সত্তার একাধিক স্থানে ব্যবসা থাকলে অবশ্যই প্রতিটি এলাকার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। কাজেই এ লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু তা দেখা যায় না।
যেমন এই লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়নের জন্য ফি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাভেদে ভিন্ন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে একটি নতুন লাইসেন্স প্রায় ১ হাজার টাকা এবং নবায়ন প্রায় ৪ হাজার টাকা। তবে অনলাইনে প্রাপ্ত লাইসেন্সের ক্ষেত্রে আবেদনপত্র ফি/লাইসেন্স বই ফি প্রয়োজন হয় না বলে জানা যায়। আবার সিটি করপোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ থেকে নবায়নের খরচ অনেক বেশি, অর্থাৎ নতুন লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে যেখানে আয়কর প্রযোজ্য নয় (আয়কর অধ্যাদেশ) কিন্তু নবায়নের ক্ষেত্রে আয়কর প্রযোজ্য। আবার মোংলা পৌরসভায় ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের সময়ও উৎসে আয়কর প্রদান করতে হয়। কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশ ২০২৩-এর ধারা, ১৩১ অনুযায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্সের নবায়নের সময় আয়কর প্রদানের বিধান রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নতুন লাইসেন্স এবং নবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম রয়েছে। অন্যান্য পৌরসভার এ-বিষয়ক তথ্যও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, যাতে কর প্রদানের বিষয়টি ক্রমান্বয়ে আরো সহজ করা যায়।
সিটি করপোরেশন আইডিয়াল ট্যাক্স শিডিউল ২০১৬ অনুযায়ী প্রায় ২৯৫টি প্রধান ব্যবসার অধীনে ৪৯১ ধরনের ব্যবসা এতে তালিকাভুক্ত রয়েছে। একক মালিকানা, অংশীদারত্ব বা কোম্পানির দেশে বৈধভাবে কাজের জন্যও একটি ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন।
সিটি কপোরেশন ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে থাকে। তবে সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর ধারা ৪১-এ করপোরেশনের কার্যাবলি সম্পর্কে বিধান দেয়া আছে। তাতে তারা তিন ধরনের বিষয়ে লাইসেন্স দেবেন বলা হয়েছে, সেগুলো হলো (ক) খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের ব্যবসার জন্য লাইসেন্স প্রদান (তৃতীয় তফসিলের ক্রমিক নং ১১.১০, (খ) বেসরকারি বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স প্রদান (তৃতীয় তফসিলের ক্রমিক নং ১৩.১) এবং (গ) বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর বস্তুর (তৃতীয় তফসিলের ক্রমিক নং ২২) ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লাইসেন্স প্রদান।
সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪১-এ উল্লিখিত তৃতীয় তফসিলে করপোরেশনের ২৮টি দায়িত্ব ও কার্যাবলির মধ্যে ওপরে বর্ণিত তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। বরং সিটি করপোরেশন সব ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের জন্য কর আদায় করবে বলা হয়েছে। কর আহরণ এবং লাইসেন্স প্রদান দুটি ভিন্ন বিষয় হতে পারে। কারণ লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে ইন্সপেকশন এবং বিভিন্ন ডকুমেন্টের হালনাগাদ তথ্য জমা প্রদানের বিষয় জড়িত এবং এগুলো প্রাপ্তিসাপেক্ষে কর্তৃপক্ষের সন্তোষটির বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ।
একই আইনের ধারা ৮২ অনুযায়ী করপোরেশন, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, প্রবিধান দ্বারা চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত সব অথবা যেকোনো কর, উপকর, রেট, টোল ও ফিস ইত্যাদি আরোপ করতে পারে। চতুর্থ তফসিলে ২৬টি ক্ষেত্রে করপোরেশন কর্তৃক আরোপণীয় কর উপকর, রেট, টোল এবং ফিসের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে পেশা বা বৃত্তির ওপর কর, করপোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স, অনুমোদন ও অনুমতির জন্য ফিস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে এ আইনের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত সব ব্যবসায়িক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদানের উল্লেখ না থাকায় সিটি করপোরেশন কর্তৃক ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি যৌক্তিক কিনা তা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
বর্তমানে ই-কমার্স বিজনেস বেশ সফল হয়েছে কিন্তু এক্ষেত্রটি ব্যবসায়ের শ্রেণী হিসেবে উল্লেখ না থাকায় তারা ট্রেড লাইসেন্স পেতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে তারা অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদনও করতে পারে না। এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সব ডিজিটাল কমার্স উদ্যোগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা ডিবিআইডি দেয়ার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরজেএসসির মাধ্যমে সব ডিজিটাল কমার্সকে ডিবিআইডি প্রদান করছে। তবে এ নিবন্ধনপত্র ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়। ডিবিআইডিকে ট্রেড লাইসেন্সের সমরূপ বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির সহায়ক নথি/সার্টিফিকেট হিসেবে কার্যকর করা যেতে পারে। এটি বাস্তবায়ন হলে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে।
অবস্থা দৃষ্টে মনে করা যেতে পারে যে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান এবং নবায়নের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সংস্কার পরিচালনা করা হয়েছে। তবে এখনো অনেক ধরনের বিষয় রয়েছে, যার সুরাহা করা দরকার। এ বিষয়গুলো উত্তরোত্তর সমাধান হলে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে।
ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড, একটি পাবলিক-প্রাইভেট ডায়ালগ প্লাটফর্ম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।