জুমবাংলা ডেস্ক : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের উৎপাদন কম দেখা গেলেও মৎস্য বিভাগের হিসেবে প্রতিবছরই গড়ছে উৎপাদনের রেকর্ড। কিন্তু তাদের দেয়া তথ্যে দেখতে পাওয়া যায় বিস্তর অসঙ্গতি। চ্যানেল-24 এর করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জেলা মৎস্য বিভাগ চাঁদপুরে ইলিশের মোট উৎপাদন দেখিয়েছে ৩৫ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন। যেখানে মেঘনা নদীর শাখা ধনাগোদা ও চাঁদপুরে অস্তিত্ববিহীন গোমতী নদীতে ইলিশের উৎপাদন দেখিয়েছে ৩৭৩ মেট্রিক টন।
ইলিশ গবেষকরা বলছেন, ধনাগোদার মতো শাখা নদীতে অপ্রত্যাশিতভাবে দু’চারটে ইলিশ ঢুকে পড়লেও এসব নদীতে নিয়মিতভাবে ইলিশ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর জেলে ও আড়ৎদাররা বলছেন, তথ্য নিতে কখনো বাজার কিংবা মাছের আড়তে আসে না মৎস্য বিভাগের লোকজন। অফিসে বসে মনগড়া হিসেবে প্রতি বছর উৎপাদন বাড়াচ্ছে মৎস্য কর্মকর্তারা। এতে চাপা পড়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ সংকটের চিত্র।
চাঁদপুরের মেঘনার একটি শাখা নদী ধনাগোদা। একেবেঁকে বয়ে গেছে মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলার উপর দিয়ে। শান্ত স্বভাবের নদীটিতে সারা বছর কমবেশি দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বর্ষায় পানি বাড়লে অন্যান্য মাছের সঙ্গে কদাচিত জেলেদের জালে উঠে আসে দু’চারটে ইলিশ। অথচ জেলা মৎস্য বিভাগ ধনাগোদা ও চাঁদপুরে অস্তিত্ববিহীন গোমতী নদী থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ইলিশের উৎপাদন দেখিয়েছে ৩৭৩.৫ মেট্রিক টন।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী স্বাক্ষরিত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ইলিশ উৎপাদন সংক্রান্ত মাসিক প্রতিবেদনের কপিতে দেখা যায়, প্রতি মাসে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ইলিশ উৎপাদনের হিসাব লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে ‘মেঘনা, ধনাগোদা ও গোমতী নদী’ থেকে এক বছরে রেকর্ড ৩৫ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন দেখানো হয়। যার মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলায় ১৮ হাজার ৯৭২.৭৫ টন, হাইমচর উপজেলায় ১০ হাজার ২৩৯ টন, মতলব উত্তর উপজেলায় ৫ হাজার ৫১৯.৫ টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৩৭৩.৫ টন ইলিশের উৎপাদন দেখানো হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ইলিশের উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় (মেঘনা নদী) ১ হাজার ৫০ মেট্রিক টন, হাইমচরে (মেঘনা নদী) ৯৪০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে (মেঘনা নদী) ৫৬২ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় (ধনাগোদা ও গোমতী নদী) থেকে ৩৬ মেট্রিক টন। আগস্ট মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ২হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন, হাইমচরে ১ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৮০০ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৫৭ মেট্রিক টন। সেপ্টেম্বর মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ৩ হাজার ১২০ মেট্রিক টন, হাইমচরে ১ হাজার ৭০৭ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ১ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৭৫ মেট্রিক টন।
অক্টোবর (মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল) মাসে ১ অক্টোবর-১১ অক্টোবর পর্যন্ত উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ৬৯৫ মেট্রিক টন, হাইমচরে ৩৭১ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ২১০ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ১৪ মেট্রিক টন। নভেম্বর মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন, হাইমচরে ৪৬০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৪৯১ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ১৮ মেট্রিক টন। ডিসেম্বর মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর
উপজেলায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন, হাইমচরে ৭৭০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৪৯৫ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ১৮ মেট্রিক টন।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন, হাইমচরে ১ হাজার ৯০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৪৬৫ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৩৮ মেট্রিক টন।
ফেব্রুয়ারি মাসে উৎপাদন দেখিয়েছে সদর উপজেলায় ২ হাজার ৩৯.৭৫ মেট্রিক টন, হাইমচরে ১ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৫১২.৫ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৪৫.৫ মেট্রিক টন। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস জাটকার অভয়াশ্রমে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কোনো উৎপাদন হয়নি।
মে মাসে সদর উপজেলায় উৎপাদন দেখিয়েছে ১ হাজার ৯১০ মেট্রিক টন, হাইমচরে ১ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ৪৩০ মেট্রিক টন এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৪২ মেট্রিক টন।
এই অর্থ বছরের স্থানীয় জেলে গৌতম দাশ বলেন, আজ থেকে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে ধনাগোদা নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যেতে। কিন্তু গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে পাওয়া যায় না। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি বাড়লে অন্যান্য মাছের সঙ্গে দু’চারটা উঠে। চর পড়ে যাওয়ায় মাছ খুব একটা পাওয়া যায় না।
মতলব দক্ষিণ বাজারের ব্যবসায়ী মো. হাসান ও সুমন সরকার বলেন, ধনাগোদা নদীতে রুই, কাতল, বোয়ালসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বছরে দুই এক মাস ধনাগোদায় ধরা পড়া ৫ থেকে ১০ কেজি ইলিশ বাজারে নিয়ে আসে জেলেরা। তা ছাড়া সারা বছরই আমরা চাঁদপুর বড় স্টেশন ও হরিনা মাছ ঘাট থেকে ইলিশ এসে বিক্রি করে থাকি। তবে কখনো আমাদের এখানে মৎস্য বিভাগের লোকজন আসেনি ইলিশের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। অফিসে বসে থেকেই এমন হিসেব করে মনে হয়।
ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, ধনাগোদা কিংবা ডাকাতিয়ার মতো শাখা নদীতে ভুল করে ইলিশের দু’একটি ঝাঁক চলে আসতে পারে, তবে এসব শাখা নদীতে স্থায়ীভাবে ইলিশ বসবাসের সুযোগ নেই। তাই এসব নদীতে মাঝে মধ্যে জেলেদের জালে দু’একটি ইলিশ ধরা পড়লেও সারা বছর ইলিশ পাওয়ার সুযোগ নেই।
হাইমচর উপজেলার চরভৈবরী আড়তের মাছ ব্যবসায়ী খোকন বলেন, বিগত ৪ থেকে ৫ বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন কমায় আড়তেও মাছ আসছে কম। তবে, মাছের হিসাব নিতে কখনই ঘাটে আসেনি মৎস্য কর্মকর্তারা। আমাদের সঙ্গে কথা না বলে তারা কিভাবে তথ্য পায়?
ইলিশের পাইকারি বাজার চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, মৎস্য বিভাগ বার্ষিক ইলিশ উৎপাদনের যেই হিসাব দিয়েছে তা আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। তারা আমাদের থেকে তথ্য না নিয়েই নিজেদের মতো তথ্য দিয়ে দিচ্ছেন। যা আসলে ঠিক নয়। মূলত গত কয়েক বছর ধরে চাঁদপুরে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছরই কমেছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চাঁদপুর জেলায় ইলিশের যেই যেই রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদন দেখিয়েছে আমরা তার দ্বিমত পোষণ করছি। তাদের এমন ভ্রান্ত হিসেবে সবার ক্ষতি হচ্ছে। এতে করে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নদীতে ইলিশ সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এমন অযৌক্তিক হিসেব প্রত্যাখ্যান করে উৎপাদনের সঠিক হিসেব তুলে ধরার দাবি জানাই।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসানকে ইলিশ উৎপাদনের হিসেব কিভাবে নেয়া হয় প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেনি। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন চাঁদপুরে গোমতী নদী নেই। তবে, কিভাবে সেই নদীর ইলিশের হিসাব তার প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ হয়েছে বিষয়টি খোঁজ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
তার দাবি, চাঁদপুরে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে। বিভিন্ন উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ইলিশ উৎপাদনের হিসাব দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে মৎস্য ব্যবসায়ীদের অভিযোগ তাদের থেকে তথ্য না নেয়ার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।