নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর : বাংলাদেশের রিভার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার, গাজীপুর নাগরিক ফোরাম ও নদী বিষয়ক পত্রিকা রিভার বাংলা’র যৌথ আয়োজনে ‘নদ-নদী ও জলাশয় সংরক্ষণ: প্রেক্ষিত গাজীপুর’ বিশেষ ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠক সোমবার (১৭ আগস্ট) বিকাল ৩.৩০টায় অনুষ্ঠিত হয়।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পরিবেশবিদ মুকিত মজুমদার বাবুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার ভার্চুয়াল এই বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আপনাদের এই উদ্যোগ জনগণকে সচেতন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।আপনাদের পর্যবেক্ষণ খুবেই মূল্যবান।আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শেখ মোজাহিদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আইনকানুন প্রয়োগের উপর নির্ভর করে, লোকবল বাড়িয়ে এটা হয় না। আমার অফিসেও লোকবল কম আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমি মেরিন কোর্টে কাজ করেছি, দৃঢভাবে করেছি।আপোষ করিনি। এখনও কাজ করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। সঠিকভাবে কাজ করলে এক বছরে চিত্র পাল্টে যাবে। আমার কাছে অভিযোগ আছে আমাদের অফিসারেরা দূর্নিতিগ্রস্থ।
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।আমাদের এখানে হাজারও নদী আমরা নদীর মর্ম বুঝি না। আমাদের আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আমরা যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, একজন কৃষক কেন নদী দখল নিয়ে ভাববে, সে তো নদী দখল করেনি। প্রশাসনকে দ্রুত নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ইটিপি অনলাইন মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। গাজীপুর জেলা শিল্পসমৃদ্ধ জেলা।অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় এখানে যখন কল-কারখানা স্থাপিত হয় তখন ইটিপি প্ল্যান্ট করা হয় না।অথচ এটা করা বাধ্যতামুলক। গাজীপুরের তুরাগ নদীকে কেন্দ্র করে ৩৫১টি, চিলাই নদী তীরে ১৩টি আর লবলং নদী তীরে ৯৭টি কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। আমাদের মানবতা নেই।তাই নদীর প্রতি অমানবিক আচরণ করছি।তবে আমরা এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি।জরিমানা করেছি। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি।পরিবেশ দূষণের কারণে আমরা জেলা প্রশাসক এর উদ্যোগে ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছি। গাজীপুরে নদী কেন্দ্রিক ১১২ টি ইটভাটাসহ জেলার ২২৬টি ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করেছি।
ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, নদীকে জীবন্ত ঘোষণা করার পরও দূষণ বন্ধ হয়নি।টনকে-টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। লিটারকে-লিটার তরল ফেলা হচ্ছে নদীতে। মানা হচ্ছে না জলাধার সংরক্ষণ আইনও। তিনি প্রস্তাব করেন- নদীর তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।গাজীপুরের পুকুরগুলোকে পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় আনতে হবে, খেলা যায়গায় ময়লা ফেলা যাবে না।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে কলাম্বিয়া ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেডের মানবসম্পদ ও প্রকৌশল প্রধান মেজর (অব) মো: ইমতিয়াজ ইসলাম বলেন, আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে পরিবেশের যে বিপর্যয় আসবে, তখন সেটা মোকাবেলা করা কঠিন হবে।আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি সেথানে ইটিপি প্ল্যান্ট কার আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা বায়ার আসলে ইটিপি প্ল্যান্ট চালু করে, চলে গেলে ইটিপি প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেয়, এটা ভয়বহ অপরাধ।আমার মনে হয় পৃথিবীর কোনো দেশে আমাদের মত নদী দখল হয় না।
রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকার নদীগুলোর যে দূষণ দেখছি এর বড় কারণ গাজীপুরের নদীগুলোর দূরাবস্থা।ঢাকার নদীগুলোকে সুরক্ষা দিতে হলে গাজীপুরের নদীগুলোকে বাদ দিয়ে করা যাবে না।গাজীপুরে যে ১৫-১৮টি নদী আছে, সেগুলোতে সীমানা ফিলার স্থাপন করতে হবে।এবিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তিনি গাজীপুরের জেলা প্রশাসনতে অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন। তিনি বলেন, গাজীপুরে এ পর্যন্ত অনেক নদ-নদী হারিয়ে গেছে। তবে এখনও ১৫টি নদ-নদী আছে।এই নদ-নদীগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।আমরা শুধু নদী থেকে নিচ্ছি বিনিময়ে নদীকে কিছুই দিচ্ছি না।উপরন্তু গলা টিপে হত্যা করছি। আলোচ্যে প্রবন্ধে তিনি গাজীপুরের নদ-নদী ও পরিবেশের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি প্রস্তাব করেন, নদী সুরক্ষায় সরকার, সাধারণ জনগন ও বেসরকারি উদ্যেগে স্মার্ট পার্টনারশীপ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পরিবেশবিদ মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, আজকের এই আলোচনায় গাজীপুরের বিষয়ে অনেককিছু আমরা জানতে পেরেছি।যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় তাহলে আমরা আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারবো।জীববৈচিত্র রক্ষা করতে না পারলে কী অবস্থা হয় তা আমরা কোভিড-১৯ এর সময়ে বুঝতে পেরেছি।আমাদের যেমন সচেতনতা দরকার তেমনি দরকার আইনের প্রয়োগ।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শেখ মোজাহিদ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি কর্মী লিয়াকত চৌধুরী, গাজীপুর নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো: জালাল উদ্দিন, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সহসভাপতি মুহাম্মদ মোশারফ হোসেন, চিলাই নদী সংরক্ষণ কমিটির সমন্বয়কারী ফরিদ উদ্দিন সোহেল, লবনদহ নদ সংরক্ষণ কমিটির সমন্বয়কারী সাঈদ চৌধুরী ও নদী পরিব্রাজক দল কালীগঞ্জ শাখার সভাপতি আব্দুর রহমান আরমান।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন সমাজ উন্নয়ন কর্মী শাহ্জিয়া শাহ্রিন আনিকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।