কামাল আতাতুর্ক মিসেল, বাসস (কুমিল্লা): প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই এলাকা। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চল শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। বঙ্গদেশে যেসব এলাকায় প্রাচীনকালে সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল তার মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতি অন্যতম।এখানে ২৩টি প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি চিহ্নিত হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ ময়নামতি ও লালমাই পাহাড় এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। তখন ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ের প্রত্নস্থলে ৫০টির অধিক ‘সাংস্কৃতিক ঢিবি’ চিহ্নিত করা হয়। পরে আশির দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে আরেক দফা অনুসন্ধান পরিচালনা করে। এ ৫০টির মধ্য থেকে ২৩টিকে প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এ পুরাকীর্তিগুলো সব সময় দর্শনার্থীদের কাছে প্রিয়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, আনন্দ মুড়া, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, ময়নামতি মাউন্ড, রানীর বাংলো ঢিবি, ভোজবিহার, রূপবান কন্যার বাড়ি, কোটবাড়ি মুড়া ও হাতিগাড়া মুড়া। এর মধ্যে শালবন বিহারে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসে। এ পুরাকীর্তির প্রাচীন নাম ‘ভবদেব মহাবিহার’। শীতের মৌসুমে ফুলে ফুলে ভরে যায় এ বিহার। দেশি পর্যটকেরা ১০ টাকায় এবং বিদেশিরা ৫০ টাকার প্রবেশমূল্যে সেখানে প্রবেশ করতে পারে।
শালবন বিহারের পাশেই ময়নামতি জাদুঘর। সেখানে সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের নানা ধরনের মূর্তিসহ ধাতব জিনিস রয়েছে। এ জাদুঘরেও কিছু সংস্কারকাজ করা হয়েছে। কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফিল্ড অফিসার (বর্তমানে আঞ্চলিক পরিচালকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে নিয়োজিত) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আমরা শালবন বৌদ্ধবিহারকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছি। সেখানে ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। পুরাকীর্তির আদল ঠিক রেখে এর ফাঁকে ফাঁকে পাকা সড়ক তৈরি করা হয়েছে।
শালবন বিহার কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত শালবন বিহার ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি। অষ্টম শতকে নির্মিত এ অমূল্য প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ স্থানটি আগে শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল। তাই বিহারটির নাম দেওয়া হয় শালবন বিহার। সেখানে খননের পর ৫৫০ ফুট এলাকাজুড়ে একটি বৌদ্ধবিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির নিদর্শন থেকে জানা যায়, দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে এ বিহার নির্মাণ করেন। তখন বিহারটির নাম ছিল ভবদেব মহাবিহার।
আরাফাত রাফি বর্তমানে এর বিপরীত পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘নব শালবন বৌদ্ধ বিহার’। ময়নামতি জাদুঘর শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রানির বাংলা, ভোজ বিহারসহ বিভিন্ন বিহার খননকালে পুরোনো দিনের অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রী খোঁজে পাওয়া যায়। রূপবান মুড়া কুমিল্লা কোটবাড়ি-কালির বাজার রাস্তার দক্ষিণে ও বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভলপমেন্ট (ইঅজউ)’র পশ্চিম সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন সমতল থেকে আনুমানিক ৬-৮ মিটার উঁচুতে রূপবান মুড়া অবস্থিত।
কুমিল্লার স্থানীয়রা সাধারণত মাটির উঁচু ঢিবিকে মুড়া বলে থাকেন। আর অনেকেই মনে করেন যে, রূপবান এখানে বসবাস করতেন তাই এর নাম রূপবান মুড়া। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে আমরা জানতে পারি এটি একটি বৌদ্ধ বিহার। রূপবান মুড়া/রূপবান কণ্যার মুড়া বা বিহার নামেও এটি পরিচিত। প্রাপ্ত বুদ্ধ মূর্তি, রাজা বলভট্টের মুদ্রা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নিদর্শনাদি পর্যালোচনা করে ধারনা করা সমীচিন যে, বিহারটি খড়গ নৃপতিদের রাজত্ব্যকালে ৬ষ্ট শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে নির্মিত হয়েছিল। এখানে ছোট আকারের একটি বিহার ও মন্দির আছে। বিহারটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক ও উভয় স্থাপনাই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ধারন করে।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ইউডিএ (আপার ডিভিশন অ্যাসিসট্যান্ট) ফজলুর রহমান জানান, ঐতিহ্যের দিক দিয়ে কুমিল্লার একটি অবস্থান রয়েছে। ওই আলোকে এখানকার প্রত্নসম্পদগুলো দর্শনার্থীরা দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করে। সরকারও প্রচুর রাজস্ব পাচ্ছে। কুমিল্লার ২৩টি পুরাকীর্তি রয়েছে এগুলোর মাধ্যমে ইতিহাস সম্পর্কে এ প্রজন্ম জানতে পারছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।