ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উপচে পড়া ভীড়। শুধু উপচে পড়া বললে ভুল হয়। ‘তিল ধারণের ঠাঁই নেই’—কথাটি বোধ হয় এরকম পরিস্থিতি বোঝানোর জন্যই বানানো হয়েছে। নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা বাংলাদেশে এসেছেন। উপচে পড়া ভীড় সে জন্যই। সবাই তাঁর কথা শুনতে চান, তাঁকে দেখতে চান।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে। প্রথম পুয়ের্তোরিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হিসেবে ২০০৪ সালের মে মাসে নাসার নভোচারী প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। ২০২৩ সালে তাঁকে নাসার নভোচারী কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সেই মানুষটি এখন সামনে দাঁড়িয়ে। দর্শকসারি থেকে উল্লাস শোনা গেল। আকাবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তার জবাব দিলেন। এরপর মঞ্চ থেকে নেমে সংরক্ষিত আসনে বসে পড়লেন। উপস্থাপক প্রথমেই অধ্যাপক মাহবুব মজুমদারকে আহ্বান করলেন কিছু বলতে। এ উদ্যোগের পেছনে তাঁর ভূমিকার কথাও জানালেন উপস্থিত সবাইকে।
অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার জানালেন, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপস্থিত সবাইকে সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানিয়ে চট করে মঞ্চ ছেড়ে দিলেন তিনি। চলে এল সেই মুহূর্ত। উপস্থাপক তা বুঝেই বললেন, ‘আমি জানি, উপস্থিত কেউ আমার কথা শুনতে চায় না। আমিও চাই না!’ এরপরেই মঞ্চে উপস্থিত হতে অনুরোধ করা হলো জোসেফ এম আকাবাকে।
এলেন তিনি। সবার প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিজ্জা খেতে পছন্দ করে কারা?’ অনেকেই হাত তুলল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘আমরা এখানে মজা করব। কিন্তু স্যাররা যেহেতু আছেন, তাঁদের দেখাতে হবে তো যে পড়াশোনা করছি!’ এই বলেই একটা ভিডিও ছেড়ে দিলেন। অডিটোরিয়ামের বিশাল স্ক্রিনে দেখা গেল, নভোচারীরা নানারকম পিজ্জা বানাচ্ছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভাসছে পিজ্জা!
সবাই হাসছে। এর মধ্যেই মাইক্রোগ্র্যাভিটি এবং ওজনহীনতার কথা বললেন তিনি। ছয় মিনিটের একটি ভিডিওতে দেখালেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাঁর সর্বশেষ মিশনের কিছু মুহূর্ত। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয় মিশনটি। শেষ হয় ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ৬ মাসের এ মিশনের মজার অভিজ্ঞতা দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। এরকম তিনটি মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। মহাকাশে কাটিয়েছেন ৩০৬ দিন।
ভিডিওর পরে প্রশ্নোত্তরের সুযোগ দেওয়া হলো। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করছেন। প্রচণ্ড কৌতূহল তাঁদের। কার্বন ক্যাপচার নিয়ে কঠিন একটি প্রশ্ন করলেন একজন। আকাবা হাত তুলে বললেন, ‘আরে আরে, এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর তো আমি পারি না!’
একের পর এক কৌতূহলী প্রশ্ন ছুটে আসতে লাগল। ‘মহাকাশে কাঁদলে পানি কি মুখের সঙ্গে লেগে থাকে?’ উত্তরের পাশাপাশি প্রায় ওজনহীন পরিবেশে পানির ফোঁটা কেমন করে ভেসে বেড়ায়, এ নিয়ে ভিডিও দেখালেন আকাবা। বললেন, ‘মহাকাশে কান্না করা নিষেধ!’ কেন?—তার জবাবে মনে করিয়ে দিলেন, পানি ঢুকে গেলে নষ্ট হতে পারে বৈদ্যুতিক যন্ত্র। মজা করে বললেন, চাইলে নিজের কম্পিউটারে পানি ঢেলে দিয়ে কেউ এক্সপেরিমেন্ট করতেই পারে!
এমন নানা প্রশ্নে, হাসি-মজায় সময় কেটে গেল। প্রশ্ন তবু শেষ হয় না। এক শিক্ষার্থী হাত তুলেছিলেন, আকাবা জানালেন, এটাই শেষ প্রশ্ন। সেই শিক্ষার্থীকে বললেন, ‘এখন তোমার ওপর অনেক চাপ! প্রশ্ন ঠিকঠাক করে করো!’ প্রশ্নটা যথার্থই ছিল। ‘কীভাবে নভোচারী হলেন আপনি?’
জবাবে রীতিমতো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন খুলে ধরলেন নাসার প্রধান নভোচারী। বড় করে তাতে লেখা: যে চারটি ভুল আমি করেছি। জানা গেল, তাঁর এককালে মেটাল শপ ছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মেরিন কর্পসে। তারপর চলে গেলেন শান্তি মিশনে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। এরপর ফিরে এসে নিলেন শিক্ষকের চাকরি। কেন এগুলো ভুল ছিল, বললেন সে কথাও—স্বেচ্ছাসেবী কাজে একদমই পয়সা নেই, আর শিক্ষকের চাকরিতেও অর্থ তুলনামূলক কম।
প্রেজেন্টেশনের পরের পৃষ্ঠাতেই দেখা গেল, এই কাজগুলোই তাঁর নভোচারী হওয়ার পথ গড়ে দিয়েছে। শান্তি মিশন শিখিয়েছে, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কীভাবে যৌথভাবে কাজ করতে হয়। শিক্ষকতা শিখিয়েছে অদ্ভুত সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। আর মেটাল শপ? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নানা কাজকর্ম। অনেক তত্ত্বকথার চেয়ে সেখানে গিয়ে হাতে-কলমে কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা প্রথমবারের মতো ঢাকা এলেন। দেশের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করাই তাঁর এ সফরের উদ্দেশ্য। এই সফরের অংশ হিসেবেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এ বক্তৃতা আয়োজিত হয়।
মহাকাশে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর এটি প্রণীত হয়। বর্তমানে এ নীতিমালায় মোট ৫০টি রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে। এটিই আর্টেমিস অ্যাকর্ডস। এ নীতিমালা নাসা ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও জোরদারে সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশের এ অ্যাকর্ডসে যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা করার কথা রয়েছে আকাবার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।