আমরা যেসব পদার্থ দেখতে পাই ও স্পর্শ করতে পারি, সেগুলো গঠিত হয়েছে কিছু মৌলিক পদার্থ দিয়ে। যেমন হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন মিলিত হয়ে অণু গঠন করে। আবার মৌলের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম একক হলো পরমাণু। এটি গঠিত হয় নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন দিয়ে। আবারও মনে করিয়ে দিই, নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন কণা। মহাবিশ্বের সবচেয়ে হালকা ও প্রাচুর্যময় মৌলের নাম হাইড্রোজেন।
এই মৌলে থাকে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রন। তবে হাইড্রোজেনের আরেকটা রূপ রয়েছে, যার নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটনের সঙ্গে একটা নিউট্রনও থাকে। এটা হাইড্রোজেনের একটা আইসোটোপ বা সমস্থানিক। আইসোটোপ মানে একই মৌলের ভিন্ন রূপ। হাইড্রোজেনের এ আইসোটোপকে বলা হয় ডিউটেরিয়াম। মৌলটির তৃতীয় আরেকটি আইসোটোপও আছে। এর নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটনের সঙ্গে থাকে দুটি নিউট্রন।
একে বলা হয় ট্রিটিয়াম। কোনো মৌলের সব আইসোটোপের প্রোটন সংখ্যা সব সময় একই থাকে, তবে তফাত থাকে তাদের নিউট্রন সংখ্যায়। বিভিন্ন মৌলের আইসোটোপের সংখ্যাও বিভিন্ন। যেমন অক্সিজেনের আইসোটোপের সংখ্যা ১৩। স্বর্ণের আবার ৩৬টি আইসোটোপ আছে।
এসব আইসোটোপের কিছু বেশ স্থিতিশীল। মানে, সেগুলো কমবেশি চিরদিন টেকে। তবে বেশির ভাগ আইসোটোপ অস্থিতিশীল। কথাটা আরেকভাবে বলা যায়, এগুলো রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়। এসব তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। অর্থাত্ বেশ দ্রুত বা কিছুটা ধীরে এসব আইসোটোপ নিজেরা অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয়। এরা যেসব মৌলে রূপান্তরিত হয়, তাদের কিছু কিছু স্থিতিশীলও হতে পারে। এভাবে একসময় থেমে যায় তাদের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়া। তবে রূপান্তরিত কিছু মৌল অস্থিতিশীলও হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে ক্ষয় প্রক্রিয়া অবিরাম চলতেই থাকে, যতক্ষণ না সেটা কোনো স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছায়। হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপের মাত্র একটি তেজস্ক্রিয়। ট্রিটিয়াম। এটি ক্ষয় হয়ে হিলিয়ামের স্থিতিশীল আইসোটোপে পরিণত হয়। অক্সিজেনের ১৩টি আইসোটোপের মধ্যে মাত্র তিনটি স্থিতিশীল। ওদিকে স্বর্ণের ৩৬টি আইসোটোপের মধ্যে স্থিতিশীল মাত্র একটি।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কত দ্রুত ক্ষয় হয়, তা মাপা হয় তাদের হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু দিয়ে। আশা করছি, কথাটা মনে রাখতে পারবেন। অর্ধায়ু এক মাইক্রোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ) থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। যদি বলা হয়, ট্রিটিয়ামের অর্ধায়ু প্রায় ১২ বছর, তাহলে তার মানে, ট্রিটিয়ামের প্রদত্ত নমুনার অর্ধেক ১২ বছরে ক্ষয় হবে (২৪ বছর পর টিকে থাকবে ওই নমুনার মাত্র এক-চতুর্থাংশ)। নিউক্লিয়ার ডিকে বা পারমাণবিক ক্ষয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
এর মাধ্যমে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মৌল রূপান্তরিত ও গঠিত হতে পারে। তবে এটা কিন্তু মোটেও আলকেমি বা অপরসায়ন নয়। আমার পিএইচডি গবেষণার সময় মাঝেমধ্যে তেজস্ক্রিয় স্বর্ণের আইসোটোপকে ক্ষয় হয়ে পারদে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। তবে প্রক্রিয়াটি মধ্যযুগের আলকেমিস্টদের ঠিক পছন্দ হতো না। অবশ্য পারদের বেশ কিছু আইসোটোপ ক্ষয় হয়ে স্বর্ণে পরিণত হয়। প্লাটিনামের কিছু আইসোটোপের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। তবে প্লাটিনামের একটামাত্র আইসোটোপ ও পারদের একটামাত্র আইসোটোপ ক্ষয় হয়ে স্থিতিশীল স্বর্ণে পরিণত হয়। মানে, আমরা হাতে-গায়ে গহনা হিসেবে যে রকম স্থিতিশীল স্বর্ণ ব্যবহার করি, সে রকম।
আমার গবেষণার কাজটা ছিল সত্যি রোমাঞ্চকর। আক্ষরিক অর্থেই আমার হাতের তালুতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ক্ষয়ে যেত। সেটা ঘটত খুব তীব্রভাবে। আমি যেসব আইসোটোপ নিয়ে কাজ করেছি, সাধারণত সেগুলোর অর্ধায়ু ছিল মাত্র এক দিন বা কয়েক দিন। যেমন স্বর্ণ-১৯৮ আইসোটোপের অর্ধায়ু আড়াই দিনের একটু বেশি। কাজেই আমাকে কাজ সারতে হতো খুব তড়িঘড়ি করে। ডেলফ থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা আমস্টারডামে যেতাম।
সাইক্লোট্রন ব্যবহার করে সেখানে এসব আইসোটোপ বানানো হতো। এরপর সেগুলো সঙ্গে নিয়ে পড়িমরি করে আবারও ফিরতাম ডেলফের ল্যাবে। ল্যাবে এসেই আইসোটোপগুলো একটা অ্যাসিডে দ্রবীভূত করে তরল বানাতাম। পরে রেখে দিতাম খুব পাতলা ফিল্মে। এরপর ঢুকিয়ে দিতাম একটা ডিটেক্টরে। সে সময় পারমাণবিক ক্ষয় সম্পর্কিত একটা তত্ত্ব যাচাইয়ের চেষ্টা করছিলাম আমি। তত্ত্বটা নিউক্লিয়াস থেকে গামা রশ্মির সঙ্গে ইলেকট্রন নিঃসরণের অনুপাতের ভবিষ্যদ্বাণী করে। আমার কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল নিখুঁত পরিমাপ।
কাজটা ইতিমধ্যে বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের জন্য সম্পন্ন করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিমাপে দেখা গেল, তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে বাস্তব ফলাফল কিছুটা আলাদা। আমার সুপারভাইজার প্রফেসর অ্যালডার্ট ওয়াপস্ট্রা পরামর্শ দিলেন, তত্ত্বটা নাকি পরিমাপ—ভুল কোনটির মধ্যে, আমি যেন তা নির্ণয়ের চেষ্টা করি। কাজটা আমার জন্য ছিল খুব আনন্দের। দারুণ কোনো জটিল ধাঁধা মেলানোর মতো। এখানে চ্যালেঞ্জটা ছিল, আগের গবেষকদের তুলনায় আমার পরিমাপগুলো অনেক বেশি নিখুঁত হতে হবে।
আধুনিক হিসাবে, মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বা ১৩৭০ কোটি বছর। যা-ই হোক, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে স্থান নিজেই ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। তাই আমরা বর্তমানে যেসব গ্যালাক্সি দেখি, সেগুলো গঠিত হয়েছে মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন বছর পর [এ ধারণাটা বর্তমানে বদলে যাচ্ছে]।
সেগুলো ১৩.৭ আলোকবর্ষের চেয়েও অনেক দূরে। জ্যোতির্বিদেরা এখন হিসাব করে দেখেছেন, আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের কিনারা আমাদের কাছ থেকে সব দিকে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। স্থানের প্রসারণের কারণে বহুদূরের গ্যালাক্সিগুলো বর্তমানে আমাদের কাছ থেকে আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। ধারণাটা অবিশ্বাস্য, এমনকি অসম্ভবও মনে হতে পারে। কারণ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বে অনুমান করা হয়েছে, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কোনো কিছু যেতে পারে না। তবে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, দুটি গ্যালাক্সির মাঝখানের স্থান যখন প্রসারিত হয়, তখন তার গতির কোনো সীমা নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।