বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে নতুন অবস্থান নিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত এই কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে না। নির্বাচনের পর নতুন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে চলমান সংস্কার কর্মসূচির ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়েই অর্থ ছাড় করতে চায় আইএমএফ।
ষষ্ঠ কিস্তি বাবদ ৮০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভার সাইডলাইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সংস্থাটি গভর্নরকে জানায়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করেই কিস্তির অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৈঠকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, নির্বাচনের আগেই ডিসেম্বরে কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি নির্ধারিত নীতিগত শর্তগুলো পূরণ করে, তবে অর্থ ছাড়ের কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। তবে আইএমএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী নির্বাচনের পর নতুন সরকার সংস্কার নীতিমালা বহাল রাখবে কি না, তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অর্থ ছাড় করা হবে না।
এদিকে ওয়াশিংটন থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় গভর্নর মনসুর বলেন,“আইএমএফের ঋণের কিস্তির টাকা এখন বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য কিছু নয়। রিজার্ভ ভালো আছে, ডলারের বাজারও স্থিতিশীল। তবে আইএমএফের নীতিসহায়তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
গভর্নর আরও বলেছেন, আইএমএফ-এর ঋণ কর্মসূচির মধ্যে সব সময় থাকতে হবে-এমন কোনো কথা নেই। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ওয়াশিংটনে গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগামী দিনে ঋণের কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে আইএমএফ যদি কঠোর কোনো শর্ত আরোপ করে, তবে তা বাংলাদেশ মেনে নেবে না। তাদের কঠিন শর্ত মেনে ঋণের অর্থ ছাড় করার মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আর নেই। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খাদের কিনারা থেকে ওঠে এসেছে। এখন চলতে শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইএমএফ-এর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, নানাভাবে চাপ দিয়ে যতদূর সম্ভব নিজেদের আরোপিত শর্তগুলো বাস্তবায়ন করানো। এজন্য সংস্থাটি সুযোগ খুঁজে। এখন আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। একে কাজে লাগিয়ে আইএমএফ তাদের শর্তগুলো বাস্তবায়ন করাতে চায়। কারণ, নির্বাচনের আগে ঋণের কিস্তি ছাড় না করলে বর্তমান সরকার ইমেজ সংকটে পড়তে পারে। ঋণের কিস্তি স্থগিত মানেই হচ্ছে আইএমএফ-এর শর্ত পালন করতে পারছে না। এমন বার্তাটিই বৈশ্বিক অঙ্গনে দিতে চাচ্ছে সংস্থাটি। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার এলে তাদের কঠিন শর্তগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি আদায় করবে। প্রতিশ্রুতি না দিলে ঋণের কিস্তি স্থগিত করতে পারে। তখন নতুন সরকার আরও বড় ধরনের চাপে পড়বে। এসব বিবেচনায় আইএমএফ সুযোগটি কাজে লাগাতে চাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সূত্র জানায়, আইএমএফ এমন চাপ এর আগেও একাধিকবার দিয়েছে। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। রিজার্ভ সংকটের কারণে পরবর্তী সময়ে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানির বকেয়া দেনা পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে ওই কিস্তির অর্থ আকু থেকে ‘সোয়াপ’ বা ঋণ হিসাবে নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওই অর্থ পরিশোধ করেছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আইএমএফ-এর ঋণ চেয়েছিল। ওই ঋণ অনুমোদন করতে দরকষাকষি হয়েছিল। ওয়াশিংটন থেকে আইএমএফ মিশনকে কমপক্ষে দুই দফা ঢাকায় আসতে হয়েছিল। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় আইএমএফ-এর কাছে বাংলাদেশ ঋণ চাইলে সংস্থাটি আগেই চাপ দিয়ে ঋণের বেশকিছু শর্ত বাস্তবায়ন করে নিয়েছিল। এর মধ্যে একদফায় জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। পাশাপাশি গ্যাস ও সারের দামও বৃদ্ধি করেছিল। ওই সময়ে দেশের মুদ্রার (টাকা) এমনভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল যে প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে তা অনেক বেশি ছিল। যে কারণে মূল্যস্ফীতি অতিমাত্রায় বেড়েছিল। টাকার বাড়তি অবমূল্যায়নের কারণেই মূল্যস্ফীতিতে এখনো বড় ধাক্কা লেগে আছে।
এদিকে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে ২৯ অক্টোবর আইএমএফ-এর একটি মিশন ঢাকায় আসছে। তারা দুই সপ্তাহ দেশে অবস্থান করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। মিশনটি ওয়াশিংটনে গিয়ে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেবে। এর ওপর নির্ভর করবে কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর কাছ থেকে ষষ্ঠ কিস্তি বাবদ ৮০ কোটি ডলারের কিছু বেশি অর্থ পাওয়ার কথা। এটি ছাড় না করলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতায় কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো, রপ্তানি আয় পরপর দুই মাসে প্রবৃদ্ধি না হলেও গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-এই তিন মাসে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। একই সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৬ শতাংশ। আমদানি ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বকেয়া ঋণ নেমে এসেছে সিঙ্গেল ডিজিটে। যে কারণে ডলারের চাপ নেই। দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। রোববার রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার ২১৪ কোটি ডলারে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবও দীর্ঘ সময়ের ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় না করলেও কোনো ক্ষতি নেই।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলার জন্য ২০২২ সালের শেষদিকে আইএমএফ-এর কাছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ঋণ সহায়তা চায়। ২০২৩ সালের জানুয়ারির শেষে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি। নতুন সরকারের সময় এ ঋণ কর্মসূচি আরও ৮০ কোটি ডলার বাড়িয়ে ৫৫০ কোটি ডলারে উন্নীত করে। ইতোমধ্যে ঋণের পাঁচ কিস্তি বাবদ ৩৬০ কোটি ডলার ছাড় করেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।