রাত দুটো। শিশু সুমাইয়ার তীব্র জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন তার বাবা রফিকুল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর জরুরি ভর্তি আর ওষুধপথ্যের খরচের হিসেব দেখে থমকে যান। সঞ্চয় ফুরিয়ে গেছে গত মাসের বড় অপারেশনেই। চোখে মুখে শুধুই অসহায়ত্ব। রফিকুলের গল্পটি একা তার নয়। বাংলাদেশে অসংখ্য পরিবার প্রতিদিন আকস্মিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হয়, যেখানে জরুরি চিকিৎসার খরচ চোখ রাঙায়। কিন্তু একটি সহজ সিদ্ধান্ত – পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত – এই আতঙ্ককে দূর করতে পারে, একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যতের ভিত গড়ে দিতে পারে। শুধু চিকিৎসার খরচ নয়, মানসিক শান্তি আর আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার হাতিয়ার এই স্বাস্থ্য বীমা। চলুন জেনে নিই, কীভাবে এই বীমা আপনার পরিবারকে অপ্রত্যাশিত বিপদ থেকে রক্ষা করে সুন্দর আগামীর পথ দেখাতে পারে।
পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমা: কেন এটি অপরিহার্য?
জীবনে অনিশ্চয়তার নামান্তর। একটি আকস্মিক অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা দীর্ঘমেয়াদী রোগ শুধু শারীরিক কষ্টই বয়ে আনে না, সঙ্গে নিয়ে আসে বিপুল আর্থিক চাপ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের (HEU) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বহির্বিভাগে চিকিৎসার গড় ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অনেক পরিবারের জন্য ‘ক্যাটাস্ট্রফিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার’-এর (অর্থাৎ আয় বা সঞ্চয়ের সিংহভাগ চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়া) কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত শুধু টাকাপয়সার হিসেব নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতার প্রতীক।
- আর্থিক সুরক্ষার ঢাল: হাসপাতালে ভর্তি, জটিল অপারেশন, দামি ওষুধ বা ডায়াগনস্টিক টেস্টের খরচ এককভাবে বহন করা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য বীমা এই বিশাল খরচের বোঝা বহনে সাহায্য করে, জীবনসঞ্চয় বা সম্পদ বিক্রির হাত থেকে রক্ষা করে।
- মানসম্মত চিকিৎসার সুযোগ: বীমা থাকলে শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়, প্রয়োজনে ভালো মানের প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়ার আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়। এটি চিকিৎসার গুণগতমান নিশ্চিত করে।
- মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ: সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মানসিক চাপ কমে যাওয়া। পরিবারের কারও অসুস্থ হলে ‘খরচ কীভাবে জোগাড় করব’ এই ভাবনা থেকে মুক্তি মেলে। চিকিৎসার দিকে পুরো মনোযোগ দেওয়া যায়।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুবিধা: অনেক স্বাস্থ্য বীমা পলিসিতে প্রিভেন্টিভ হেলথ চেকআপ (Preventive Health Checkup)-এর সুবিধা থাকে। বছরে একবার বা দুবার বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যায়, যা প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা সহজ করে তোলে।
- দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনা: স্বাস্থ্য বীমা একটি দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনার অংশ। এটি পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য জরুরি তহবিল গঠনে সাহায্য করে, অন্যান্য লক্ষ্য (যেমন সন্তানের পড়াশোনা, বাড়ি কেনা) থেকে তহবিল সরানোর প্রয়োজন হয় না।
বাস্তব উদাহরণ: কল্পনা করুন, ঢাকার বসবাসরত মি. খান। তার পরিবারে স্ত্রী, দুই সন্তান ও বয়স্ক মা আছেন। তিনি একটি ভালো স্বাস্থ্য বীমা পলিসি নিয়েছিলেন। হঠাৎ করে তার মায়ের হার্টের সমস্যা দেখা দেয়, বাইপাস সার্জারি প্রয়োজন হয়। প্রাইভেট হাসপাতালে সার্জারি ও হাসপাতালে থাকার মোট খরচ প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। তার বীমা পলিসি ‘ক্যাশলেস হাসপাতালাইজেশন’ সুবিধার কারণে হাসপাতাল সরাসরি বীমা কোম্পানির সাথে সমন্বয় করে খরচ নিষ্পত্তি করে। মি. খানকে শুধু প্রাথমিক ডিপোজিট দিতে হয়েছিল। তার সঞ্চয় অক্ষুণ্ণ রইল, মানসিক চাপ ছিল ন্যূনতম। এটাই পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত এর বাস্তব রূপ।
পরিবারের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য বীমা পলিসি কীভাবে বেছে নেবেন?
সব স্বাস্থ্য বীমা পলিসি এক রকম নয়। আপনার পরিবারের সুনির্দিষ্ট চাহিদা, আর্থিক সামর্থ্য এবং স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর ভিত্তি করে সঠিক পলিসি বেছে নেওয়াটাই পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত এর মূলমন্ত্র। বিবেচ্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- পরিবারের সদস্যদের তালিকা ও বয়স:
- কারা বীমার আওতায় থাকবেন? (পিতা, মাতা, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি?)
- বর্তমান বয়স কত? বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিমিয়াম বাড়ে এবং কিছু বীমা বয়সের সীমা নির্ধারণ করে দেয়।
- সন্তানদের বয়স? অনেক পলিসিতে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত (সাধারণত ১৮-২৫ বছর) সন্তানরা মূল পলিসির অধীনে বিনামূল্যে বা স্বল্প প্রিমিয়ামে কভার পায়।
- সুম অ্যাশ্যোর্ড (Sum Assured – বীমাকৃত অর্থের পরিমাণ):
- এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। পরিবারের সদস্যদের বর্তমান স্বাস্থ্য অবস্থা, ঢাকার/বড় শহরের বাসিন্দা হলে চিকিৎসার উচ্চ খরচ, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি (পারিবারিক ইতিহাস) বিবেচনা করে পর্যাপ্ত পরিমাণ (সাধারণত ৫ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ১০/২০/৫০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি) সুম অ্যাশ্যোর্ড নির্বাচন করুন।
- পরামর্শ: আজকের চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি ভবিষ্যতের মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) মাথায় রেখে একটু বেশি সুম অ্যাশ্যোর্ড নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অপর্যাপ্ত সুম অ্যাশ্যোর্ড জরুরি মুহূর্তে বিপদে ফেলতে পারে।
- কভারের ধরণ (Scope of Coverage):
- হাসপাতালে ভর্তির খরচ: রুম রেন্ট, ডাক্তারের ফি, সার্জারি খরচ, ওষুধপথ্য, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, আইসিইউ চার্জ ইত্যাদি। এটি মৌলিক কভার।
- প্রি ও পোস্ট হসপিটালাইজেশন খরচ: হাসপাতালে ভর্তির আগে (সাধারণত ৩০-৬০ দিন) এবং ডিসচার্জের পরে (সাধারণত ৬০-৯০ দিন) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ।
- ডে কেয়ার প্রসিডিউর: যেসব চিকিৎসা প্রক্রিয়া ২৪ ঘন্টার কম সময়ে সম্পন্ন হয় (যেমন কেমোথেরাপি, ডায়ালাইসিস, কিছু ছোট অপারেশন)।
- অ্যাম্বুলেন্স চার্জ: জরুরি ভর্তির সময় অ্যাম্বুলেন্স খরচ।
- ক্যাশলেস সুবিধা (Cashless Facility): নেটওয়ার্ক হাসপাতালে সরাসরি বীমা কোম্পানির সাথে বিল নিষ্পত্তি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা। নেটওয়ার্ক হাসপাতালের সংখ্যা ও মান যাচাই করুন।
- প্রাক-বিদ্যমান রোগ (Pre-existing Diseases – PED): বীমা নেওয়ার আগে থেকে থাকা রোগ (যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার ইত্যাদি) কভার করা হবে কিনা? কত মাসের ওয়েটিং পিরিয়ড (সাধারণত ২-৪ বছর) পরে কভার হবে? এটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পড়ুন এবং বুঝুন।
- ক্রিটিক্যাল ইলনেস (Critical Illness – CI) কভার: ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি নির্দিষ্ট জীবনঘাতী রোগের জন্য এককালীন অর্থ প্রদান। এটি মূল স্বাস্থ্য বীমার অতিরিক্ত সুবিধা হতে পারে।
- মাতৃত্ব সুবিধা (Maternity Cover): গর্ভধারণ ও প্রসব সংক্রান্ত খরচ। ওয়েটিং পিরিয়ড থাকে (সাধারণত ২-৪ বছর)। সন্তান পরিকল্পনা থাকলে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
- এক্সিক্লুশন (Exclusions): কোন কোন অবস্থা বা চিকিৎসা বীমার আওতায় পড়বে না? (যেমন কসমেটিক সার্জারি, ডেন্টাল ট্রিটমেন্ট, এইচআইভি/এইডস, যুদ্ধ/দাঙ্গাজনিত আঘাত, মাদকাসক্তি ইত্যাদি)। এক্সিক্লুশন ক্লজ ভালো করে পড়ুন।
- প্রিমিয়াম (বীমা প্রিমিয়াম):
- আপনার আর্থিক সামর্থ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রিমিয়াম নির্বাচন করুন।
- প্রিমিয়াম নির্ভর করে সুম অ্যাশ্যোর্ড, বয়স, মেডিকেল হিস্ট্রি, পলিসির ধরন, কভারের পরিধি, ক্লেইম হিস্ট্রি এবং কোম্পানির উপর।
- বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে কোটেশন (Quotation) তুলনা করুন।
- মনে রাখুন, শুধু কম প্রিমিয়ামের লোভে পড়ে অপর্যাপ্ত কভার নেওয়া ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হবে।
- ক্লেইম নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া (Claim Settlement Process):
- ক্লেইম নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া কতটা সহজ ও স্বচ্ছ?
- ক্যাশলেস ক্লেইমের ক্ষেত্রে হাসপাতালে কতটা সহযোগিতা পাওয়া যায়?
- রেইমবার্সমেন্ট (Reimbursement – নিজে খরচ করে পরে দাবি করা) ক্লেইমের ক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া কেমন? সময়সীমা কত?
- কোম্পানির ক্লেইম নিষ্পত্তি অনুপাত (Claim Settlement Ratio – CSR) কত? এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) বা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) এর ওয়েবসাইটে CSR পাওয়া যায়। ৮৫%+ CSR ভালো, ৯০%+ অনেক ভালো। বিআইএ ওয়েবসাইট বা আইডিআরএ বাংলাদেশ এর দিকে নজর রাখুন।
- বীমা কোম্পানির সুনাম ও সেবা:
- কোম্পানির আর্থিক স্থিতিশীলতা, বাজার সুনাম, গ্রাহক সেবার মান যাচাই করুন।
- অনলাইন রিভিউ, পরিচিতজনের অভিজ্ঞতা বা স্বাধীন রেটিং এজেন্সির রিপোর্ট দেখতে পারেন।
- এজেন্ট বা ডিরেক্ট সেলস এক্সিকিউটিভের আচরণ ও জ্ঞানগত দক্ষতা মূল্যায়ন করুন।
পরিবারের স্বাস্থ্য বীমা নেওয়ার আগে করণীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত শুধু পলিসি কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নেওয়ার আগে কিছু সতর্কতা ও প্রস্তুতি জরুরি:
- পূর্ণাঙ্গ ও সত্য মেডিকেল ডিক্লেয়ারেশন: বীমা ফর্মে পরিবারের প্রত্যেকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রশ্নের সত্য ও পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া অত্যাবশ্যক। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, পূর্বের অপারেশন, পারিবারিক রোগের ইতিহাস – কোন কিছুই লুকাবেন না। লুকোনোর কারণে ভবিষ্যতে ক্লেইম বাতিল হতে পারে।
- মেডিকেল চেক-আপ: বয়স বা নির্দিষ্ট সুম অ্যাশ্যোর্ডের উপরে পলিসি নিলে বীমা কোম্পানি মেডিকেল টেস্ট করানোর জন্য বলতে পারে। প্রেসক্রাইব করা টেস্টগুলো সতর্কতার সাথে করিয়ে নিন।
- পলিসি ডকুমেন্ট ভালো করে পড়া ও বোঝা: পলিসি শর্তাবলী (Policy Wordings) খুব ভালো করে পড়ুন। বিশেষ করে কভার, এক্সক্লুশন, ওয়েটিং পিরিয়ড, সাব-লিমিট (কোন খরচের সর্বোচ্চ সীমা), কো-পে (আপনার অংশের খরচ) এবং ক্লেইম প্রসিডিউর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিন। না বুঝলে এজেন্ট বা কোম্পানির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইতে দ্বিধা করবেন না।
- পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা: স্বাস্থ্য বীমা একটি যৌথ সিদ্ধান্ত। পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করে সচেতনতা তৈরি করুন। পলিসির বিশদ তাদের জানান।
- বাজেট তৈরি করা: বার্ষিক প্রিমিয়াম আপনার পরিবারের আর্থিক পরিকল্পনার একটি অংশ। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী খরচ। সামর্থ্যের মধ্যে বাজেট করে নিন।
স্বাস্থ্য বীমা পলিসি নেওয়ার পর করণীয়
- পলিসি ডকুমেন্ট নিরাপদে সংরক্ষণ: মূল পলিসি ডকুমেন্ট, প্রিমিয়াম রশিদ, ক্লেইম ফর্মের কপি – সবকিছু নিরাপদ স্থানে (ফিজিক্যালি ও ডিজিটাল কপি) সংরক্ষণ করুন।
- নেটওয়ার্ক হাসপাতালের তালিকা হাতের কাছে রাখা: জরুরি অবস্থায় কোন হাসপাতালে যেতে হবে তা আগে থেকে জেনে রাখুন। কোম্পানির ওয়েবসাইট বা অ্যাপে সাধারণত হালনাগাদ তালিকা থাকে।
- প্রিমিয়াম সময়মতো পরিশোধ: প্রিমিয়াম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করুন। গ্রেস পিরিয়ডের পরও বাকি থাকলে পলিসি ল্যাপ্স (বাতিল) হয়ে যেতে পারে।
- ক্লেইমের সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: হাসপাতালের সকল প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট, বিল, রশিদ, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট ইত্যাদি সযতনে সংরক্ষণ করুন। ক্যাশলেস ক্লেইমের জন্য হাসপাতালের বীমা সেল বা কোম্পানির কাছে প্রি-অথরাইজেশন নেওয়া জরুরি।
- নিয়মিত পর্যালোচনা: পরিবারের সদস্য সংখ্যা, বয়স, আর্থিক অবস্থা, স্বাস্থ্যের পরিবর্তন এবং বাজারে নতুন নতুন পলিসি আসার কারণে প্রতি ২-৩ বছর পর আপনার পলিসি রিভিউ করুন। প্রয়োজনে কভারেজ বাড়ানোর (Top-up/Super Top-up) দিকে নজর দিন।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমা: বর্তমান চিত্র ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমার প্রসার দিন দিন বাড়লেও এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (BBS) বা আইডিআরএ এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশই স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আছে। এর পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- সচেতনতার অভাব: অনেক মানুষ এখনও স্বাস্থ্য বীমার গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে সচেতন নন।
- জটিলতা ও অবিশ্বাস: পলিসির শর্তাবলী জটিল মনে হওয়া, ক্লেইম প্রক্রিয়ায় জটিলতা বা ক্লেইম নিষ্পত্তি না হওয়ার গুজবের প্রতি ভয়।
- আর্থিক সামর্থ্যের অভাব: অনেকের কাছে বার্ষিক প্রিমিয়াম একটি অতিরিক্ত বোঝা বলে মনে হয়।
- গ্রামীণ পর্যায়ে সেবার অভাব: বীমা কোম্পানির নেটওয়ার্ক ও সেবা শহরকেন্দ্রিক, গ্রামীণ এলাকায় পৌঁছানো সীমিত।
তবে আশার কথা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্য বীমার প্রসার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। মাইক্রো হেলথ ইনস্যুরেন্স, কমিউনিটি বেজড হেলথ ইনস্যুরেন্সের মতো মডেল এবং সরকারের ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ কর্মসূচির মতো পদক্ষেপ ইতিবাচক। তবুও, পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত কে জনপ্রিয় করতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
(No Heading)
পরিবারের প্রতিটি হাসি, প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে একটাই চাহিদা – নিরাপত্তা। পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমার পরামর্শ: নিরাপদ ভবিষ্যত এই নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ। এটি শুধু একটি আর্থিক পণ্য নয়, এটি দায়িত্বশীল পরিবারের প্রধান কর্তার একটি অপরিহার্য সিদ্ধান্ত। আজকের এই বিনিয়োগই আগামীকালের আকস্মিক সংকটে পরিণত হতে পারে আপনার পরিবারের সবচেয়ে মজবুত ভরসাস্থল। অসুস্থতার সময় চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা নয়, সুস্থ হয়ে ওঠার দিকেই মনোনিবেশ করার সুযোগ দিতে পারে এই বীমা। ঝুঁকি নেবেন না। সময় নষ্ট করবেন না। আজই বসে পড়ুন, পরিবারের প্রয়োজন বুঝে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির পলিসিগুলো খুঁটিয়ে দেখুন, পরামর্শ নিন। সেই নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপনের জন্য একটি উপযুক্ত স্বাস্থ্য বীমা পলিসি বেছে নিন। আপনার পরিবারের সুস্থতা ও নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
জেনে রাখুন –
প্রশ্ন: স্বাস্থ্য বীমা নিতে আমার বয়স কত হওয়া উচিত? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!
- উত্তর: যত কম বয়সে স্বাস্থ্য বীমা নেবেন, বার্ষিক প্রিমিয়াম তত কম হবে। তরুণ বয়সে সাধারণত স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকে, তাই কোম্পানিও কম প্রিমিয়াম ধার্য করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিমিয়াম বাড়ে এবং নতুন পলিসি নেওয়া কঠিন হতে পারে। ২৫-৩৫ বছর বয়সে শুরু করা আদর্শ। সন্তান জন্মের পরপরই তাকে পলিসির আওতায় আনা যায়।
- প্রশ্ন: প্রাক-বিদ্যমান রোগ (যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন) থাকলে কি স্বাস্থ্য বীমা মিলবে?
- উত্তর: হ্যাঁ, মিলতে পারে, তবে শর্ত আছে। আপনাকে অবশ্যই বীমা ফর্মে এই রোগের কথা পূর্ণ বিবরণ দিয়ে জানাতে হবে। বেশিরভাগ পলিসিতে প্রাক-বিদ্যমান রোগের জন্য একটি ওয়েটিং পিরিয়ড (সাধারণত ২ বছর থেকে ৪ বছর) থাকে। এই সময়কাল পরেই সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসা বীমার আওতায় আসবে। লুকালে ক্লেইম প্রত্যাখ্যান হতে পারে। কিছু বিশেষ পলিসি উচ্চ প্রিমিয়ামে শর্টার ওয়েটিং পিরিয়ডে কভার দিতে পারে।
- প্রশ্ন: স্বাস্থ্য বীমা করলে কি সব হাসপাতালে চিকিৎসা করানো যাবে?
- উত্তর: ‘ক্যাশলেস’ সুবিধা পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার বীমা কোম্পানির ‘নেটওয়ার্ক হাসপাতালে’ যেতে হবে। এই হাসপাতালগুলোর সাথে কোম্পানির চুক্তি থাকে, যেখানে সরাসরি বিল নিষ্পত্তি হয়। নেটওয়ার্কের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা করালে আপনি নিজে খরচ করে পরে ‘রেইমবার্সমেন্ট’ ক্লেইম করতে পারেন (প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ), তবে এটি প্রক্রিয়াজাত হতে কিছু সময় লাগতে পারে এবং ক্যাশলেসের মতো তাৎক্ষণিক সুবিধা মিলবে না। তাই নেটওয়ার্ক হাসপাতালের তালিকা ও মান আগেই জেনে নিন।
- প্রশ্ন: বার্ষিক প্রিমিয়াম ছাড়া অন্য কোনো খরচ আছে কি?
- উত্তর: মূলত বার্ষিক প্রিমিয়ামই প্রধান খরচ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হতে পারে:
- কো-পেমেন্ট (Co-payment): কিছু পলিসিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ (যেমন ১০% বা ২০%) খরচ আপনাকে নিজে বহন করতে হয়, বাকিটা বীমা দেয়। এটি সাধারণত নির্দিষ্ট বয়সের উপরে বা নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
- ডিডাক্টিবল (Deductible): একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ (যেমন প্রতি বছর প্রথম ৫০০০ টাকা) আপনাকে আগে বহন করতে হয়, তারপর বীমা কার্যকর হয়। সাধারণত কম প্রিমিয়ামের পলিসিতে থাকে।
- রুম রেন্ট সাব-লিমিট: পলিসিতে রুম রেন্টের জন্য আলাদা সীমা থাকতে পারে। আপনি যদি তার চেয়ে দামি রুম নেন, তাহলে পার্থক্যের টাকা নিজে দিতে হবে।
পলিসি কিনে নেওয়ার আগে এই শর্তগুলো ভালো করে জেনে নিন।
- উত্তর: মূলত বার্ষিক প্রিমিয়ামই প্রধান খরচ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হতে পারে:
- প্রশ্ন: একবার স্বাস্থ্য বীমা নিলে কি সারা জীবন কভার থাকবে?
- উত্তর: সাধারণত না। অধিকাংশ স্বাস্থ্য বীমা পলিসি ‘রিনিউয়েবল’ (Renewable), মানে প্রতি বছর প্রিমিয়াম দিয়ে একে নবায়ন (Renew) করতে হয়। যতক্ষণ আপনি প্রিমিয়াম দিতে থাকবেন এবং পলিসি ল্যাপ্স না হবে, ততক্ষণ কভার থাকবে। অনেক পলিসিতে ‘লাইফ টাইম রিনিউয়েবিলিটি’ (Lifetime Renewability) সুবিধা থাকে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়স (যেমন ৬০/৬৫/৭০/৮০ বছর) পর্যন্ত আপনি পলিসি নবায়ন করতে পারবেন। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিমিয়ামও বাড়বে।
- প্রশ্ন: স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম কি আয়কর ছাড়ের সুবিধা দেয়?
- উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম আয়কর আইনের ধারা ৪৪(২) এর অধীনে কর-ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। একক ব্যক্তি হিসেবে বছরে সর্বোচ্চ ৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বীমা প্রিমিয়াম কর-ছাড়ের আওতায় পড়ে। আপনার এবং আপনার স্বামী/স্ত্রী, অবিবাহিত সন্তান ও নির্ভরশীল পিতা-মাতার জন্য প্রিমিয়াম এই ছাড়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রিমিয়াম রশিদ সংরক্ষণ করুন এবং আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় উল্লেখ করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।